দিল্লীর যন্তর-মন্তরে সবে পৌঁছেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনও মঞ্চে ওঠেননি। মমতার সেই আগমন বার্তা আসতেই তুমুল হর্ষধ্বনিতে ভেসে গেল সভাস্থল। মমতা মঞ্চে পা দিতেই উৎসবের আবহ সভায়। বেজে উঠল জনপ্রিয় বলিউডি গানের প্যারডি – ও মোদী দিল্লী কে লিয়ে তু তো হানিকারক হ্যায়।
ভারতীয় রাজনীতির মহারথীরা হাজির ছিলেন দিল্লীর যন্তর-মন্তর রোডের ধর্না সমাবেশে। কিন্তু কাউকেই এভাবে স্বাগত জানানো হয়নি যে ভাবে অভ্যর্থনা পেলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি বিরোধী শিবিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অলিখিত স্বীকৃতি দেওয়ার আবহও তৈরি হয়ে গেল মঞ্চে।
সমাবেশের প্রায় প্রত্যেক নেতাই নিজের ভাষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে দু-চার কথা আলাদা ভাবে খরচ করতে বাধ্য হলেন।সপার অন্যতম শীর্ষনেতা তথা অখিলেশ যাদবের কাকা রামগোপাল যাদব বললেন, ‘মমতা সংঘর্ষের প্রতিমূর্তি।’ বললেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এমন ঘটতে দেখেছেন যে, সিবিআই যাচ্ছে পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে?’ রাষ্ট্রীয় লোক দলের ত্রিলোক ত্যাগী বললেন, ‘মঞ্চে রয়েছেন মমতা দিদি, যাঁকে এখন মোদী ভয় পেয়ে গিয়েছেন।’ আর আপের সঞ্জয় সিংহ বললেন, ‘কলকাতার ব্রিগেডে মমতা দিদি যে র্যালি করেছিলেন, সেখানে যে লক্ষ লক্ষ লোক এসেছিলেন, তা দেখে মোদীর তোতা উড়ে গিয়েছিল। আর তার পরে আমরা সবাই জানি, মোদীর তোতারা পৌঁছে গিয়েছিল কলকাতায়, পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে।’
এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ার থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা, কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা থেকে অরুণাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গেগং আপাং – প্রবীণ নেতাদের প্রত্যেকের ভাষণে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমীহ। এ দিনের সভার আয়োজক হিসেবে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বিশেষ ধন্যবাদ অনেকেই দিচ্ছিলেন। তার পাশাপাশি মমতার বিশেষ ভূমিকার কথাও মনে করালেন শরদ পওয়ার। ‘দেশ, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় যে লড়াই দরকার, সেই লড়াইয়ের পথ দেখালেন মমতা ও কেজরীবাল।’ মন্তব্য পওয়ারের। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা তেলুগু দেশম প্রধান চন্দ্রবাবু অকপটে জানালেন – কলকাতায় যে বিশাল সমাবেশের আয়োজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন, অত বড় সমাবেশ তিনি কখনও দেখেননি।
এর পরে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের ভাষণের পালা। ‘বঙ্গাল কি শেরনি’, ‘আয়রন লেডি’, এমন নানা বিশেষণে আখ্যায়িত করে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানালেন আপ নেতৃত্ব। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণের শুরুতেই দাবি করলেন, ‘আর বেশি দিন নয়, ২০-২২ দিন রয়েছে মোদী সরকারের আয়ু’। মমতার আহ্বান, ‘কেউ ভয় পাবেন না’। নিজের ভাষণের ছত্রে ছত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, মোদী বিরোধী ব্রিগেডের একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়াতে তিনি প্রস্তুত। কখনও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআই পাঠানো নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন। কখনও আচম্বিত কটাক্ষে বলেছেন, ৫৬ ইঞ্চি ছাতি রয়েছে তো কী হয়েছে, সে তো রাবণেরও ছিল! কখনও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন, ‘বাংলায় ৪২টি আসনের সবক’টি তৃণমূল পাবে’।
কলকাতার সমাবেশের আয়োজক ছিলেন মমতা নিজে। সে সমাবেশের অতিথিরা মমতাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেবেন নিজেদের ভাষণে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু দিল্লীতে আয়োজিত এক যৌথ সমাবেশ, আয়োজক আম আদমি পার্টি, হাজির বিরোধী শিবিরের রথী-মহারথীরা এবং প্রায় প্রত্যেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে যাচ্ছেন যে, মোদী বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এখন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এমন পরিস্থিতি কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে আগে কখনও তৈরি হয়নি। জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে অনেক দশক ধরে যাতায়াত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু বুধবার যন্তরমন্তরের মঞ্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ভাবে স্বীকৃতিটা দিল, এর আগে সর্বভারতীয় স্তরের আর কোনও যৌথ মঞ্চ তাঁকে সে ভাবে মধ্যমণি করে তুলেছিল কি না, মনে করতে পারছেন না তৃণমূল নেতারাও।