দোরগোড়ায় লোকসভা নির্বাচন। ভোটের আগে তাই রাজ্যে অশান্তি ছড়াতে চাইছে কিছু মানুষ। চলছে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে মানুষকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা। গত কয়েক দিন ধরেই গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ একটা অংশ নানা ভুয়ো খবরে ছেয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে, রাজ্যের একটা অংশে নাকি দুষ্কৃতীরা ঢুকে পড়েছে! তারা নাকি ভয়ানক সব কাজকর্মও করছে! ‘প্রমাণ’ হিসাবে শেয়ার করা হচ্ছে কিছু ছবি এবং ভিডিয়োও।
প্রথমেই জানিয়ে রাখা যাক, বিষয়টা সম্পূর্ণ ভাবে গুজব। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত বাস্তবের কোনও মিল পায়নি পুলিশ। তারা নিজেরা তো নজরদারি চালাচ্ছে, একইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে— অযথা ভয় পাবেন না অকারণে। আতঙ্ক বা গুজব ছড়াবেন না। এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে লাগাতার প্রচার করে চলেছে পুলিশ। কিন্তু, কিছুতেই গুজব থামানো যাচ্ছে না। দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ছে। অপরিচিত এবং বহিরাগত কাউকে দেখলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে সন্দেহ করতে শুরু করছে। দু’এক জায়গায় তার পরিণাম ভয়ানক হয়ে উঠেছে।
আবার, গুজবের শিকার হয়ে ইতিমধ্যেই ডায়মন্ড হারবার মহকুমায় জনতার পিটুনিতে প্রাণ গিয়েছে দু’জনের। দুটো ঘটনাই ঘটেছে মগরাহাট থানা এলাকায়। গত শনিবার দুপুরে উড়িষ্যা থেকে আসা কাপড়ের এক ফেরিওয়ালা সুমন দাসকে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে মগরাহাটের মুলটিতে। ওই দিন রাতেই ভবঘুরে এক মধ্যবয়সী মহিলাকেও গণপিটুনি দিয়ে মারা হয় মগরাহাটেরই চাঁদপুরে। এ ছাড়াও গত কয়েক দিনে গুজবের জেরে একাধিক গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলেও দাবি করেছে পুলিশ। সেই সব ঘটনায় বেশ কয়েক জন আহত হয়েছেন।
পুলিশ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। গুজব ছড়ালে বা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করলে অথবা কোনও গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে জেলা পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর (০৩৩ ২৪৯৭ ৮৪৬৫) জানিয়ে বলা হয়েছে সেখানে যোগাযোগের কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার তালদি, ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, বারুইপুর, মগরাহাট, ডায়মন্ড হারবার— একের পর এক জায়গা এই গুজবের শিকার। পথেঘাটে কান পাতা দায় হয়েছে।
আমজনতার কাছে কী ‘খবর’ ছড়িয়ে পড়ছে? রাজ্যে ঢুকে পড়েছে দুষ্কৃতীরা। তাদের পোশাকের আড়ালে রয়েছে তলোয়ার। কখনও জল চাওয়ার অজুহাতে, কখনও খাবার চাওয়ার নামে নাকি ঘরে ঢুকে পড়ছে তারা। তার পর বাড়ির সকলের মাথা নয় তো পেট কেটে দিচ্ছে নির্মম ভাবে। ট্রেন, বাস, অটো, ট্রেকার, টোটো, পাড়ার মোড়, বাড়ির অন্দরমহল— সর্বত্রই একটাই আলোচনা, ‘দুষ্কৃতীরা ঢুকে পড়েছে’, ‘গলা কেটে ফেলছে’, ‘পেট কেটে কিডনি বার করে নিচ্ছে’… ইত্যাদি। অথচ একটি ঘটনারও কোথাও পুলিশে অভিযোগ করা হয়নি!
সাম্প্রতিক কালে কখনও ছেলেধরা, কখনও গরু চুরি, কখনও কিডনি চুরি, কখনও গরু পাচার— সামাজিকমাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে লাগামছাড়া হিংসার দরজা খুলে গিয়েছে এ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যাচ্ছে এই সব ভুয়ো খবর। গুজব ছড়াতে হোয়াটসঅ্যাপকে সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হলেও পিছিয়ে নেই ফেসবুক, টুইটারের মতো অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমও। কখনও কখনও মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলিও হয়ে পড়ছে এই সব ‘ফেক নিউজ’-এর শিকার।
প্রথমে ভুয়ো খবর, গুজব ছড়ানো হয়েছে একের পর এক জায়গায়। তার পর উন্মত্ত জনতার হাতে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ গিয়েছে একাধিক মানুষের। সর্বত্রই একই চিত্রনাট্য। শুধু বদলে গিয়েছে স্থান-কাল-পাত্র। উত্তরপ্রদেশের দাদরি হোক বা বুলন্দশহর, রাজস্থান হোক বা অসম, কর্ণাটক, ত্রিপুরা থেকে গুজরাত— গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যেন মারণ ভাইরাসের মতো। এ রাজ্যেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে, এ বার দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যে ভাবে ভুয়ো খবর, গুজব এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তা অতীতে দেখা যায়নি বলেই পুলিশ কর্তাদের দাবি।
আতঙ্ক এমন জায়গায় পৌঁছেছে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পর বাড়ি থেকে কেউ আর বেরোচ্ছেন না। দরজা-জানলা বন্ধ করে কার্যত ভয়ে কাঁপছেন। সন্ধ্যার পর ছেলেমেয়েদের টিউশন নিতেও পাঠাচ্ছেন না বাবা-মায়েরা। অনেকেই কর্মস্থল থেকে দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে বাড়ি ফিরছেন। আতঙ্ক কতটা ছড়িয়ে পড়েছে তা বোঝা যায় বারুইপুরের বাসিন্দা রূপসী দলুইয়ের কথায়। তিনি বলেন, ‘কোথায় কী হয়েছে জানি না। তবে মোবাইলে যা সব ছবি দেখলাম, ভয়ে হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। রাতে তো বিছানায় শাবল নিয়ে শুচ্ছি। যদি ওরা আসে, তখন কাজে লাগবে।’
সকলেই মোবাইল দেখিয়ে বলছেন, এই তো ছবি দেখতে পাচ্ছেন না! কিন্তু, ওই ছবি যে সত্যি, সেটা কী করে বুঝছেন? এ সব প্রশ্নের জবাব দিতে চায় না গুজবে আক্রান্ত জনতা। ক্যানিংয়ের বাসিন্দা তারাপদ নস্করের যেমন পাল্টা প্রশ্ন, ‘ঘটনা না যদি না-ই হবে, তা হলে ছবি এল কোথা থেকে?’ আপনি কি নিজের চোখে এমন কোনও ঘটনা দেখেছেন? তারাপদবাবুর জবাব, ‘না।’
আবার পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা সুভাষ দাস বলছেন, উস্তি এলাকায় এক মহিলাকে রাস্তায় হঠাৎই নাকি পিছন থেকে মুখে কিছু চেপে ধরা হয়। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। কিন্তু, এলাকাবাসী দেখে ফেলায় ওই মহিলাকে রাস্তায় ফেলে তারা পালায়। সুভাষবাবু জানান, তাঁর শ্যালিকার বাড়ি উস্তির পদ্মপুকুরে। সেই শ্যালিকাই তাঁকে ঘটনাটির কথা জানিয়েছেন। শ্যালিকা নিজে দেখেছেন ঘটনাটি? সুভাষবাবুও বললেন, ‘না, তিনিও শুনেছেন।’
এ প্রসঙ্গে ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার সুপার এস সেলভা মুরুগান বলেন, ‘আমরা গোটা এলাকায় পিকেটিং এবং পেট্রোলিং বাড়িয়েছি। মানুষের মন থেকে আতঙ্ক তাড়ানোর চেষ্টা করছি। গুজব ছড়ানোর জন্য আমতলা এলাকা থেকে পল্লব কয়াল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে ফলতা থানার পুলিশ। ধৃত ওই ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন।’ অর্থাৎ পুলিশ যে তৎপর সে কথা পুলিশ সুপারের কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রশাসনের এখন একমাত্র লক্ষ্য, মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দূর করা।