সোমবার শেষ হল বই আর পাঠকের মিলনমেলা, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। তবে মেলা শেষ হলে কী হবে, একইসঙ্গে আগামী বছরের মেলার জন্য উদ্দীপনারও জন্ম হল গতকালই। শেষ দিনে আগামী বছরের বইমেলার স্থান নিয়ে কৌতূহল দেখা গিয়েছে ক্রেতা থেকে শুরু করে বইয়ের স্টলগুলির কর্মীদের মধ্যে। বইমেলা কি ফের মিলন মেলায় ফিরে যাবে? ঘুরেফিরে উঠেছে সেই প্রশ্ন। তবে এ ব্যাপারে কিছু খোলসা করেননি উদ্যোক্তারাও। ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’-এর ডিরেক্টর সুধাংশু শেখর দে রহস্য জিইয়ে রেখে বলেন, দেখাই যাক না কী হয়! তবে জানা গেছে, আগামী বছরের বইমেলার থিম হতে চলেছে রাশিয়া।
প্রতিবারই বইমেলার ক’দিন মেলায় আসা পাঠক–ক্রেতার সংখ্যা এবং বই বিক্রির টাকার অঙ্ক গতবারের রেকর্ডকে ভেঙে দেয়। এবারও দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে মেলার বিক্রিবাটা দেখে মোটের উপরে খুশি প্রকাশকরা। সোমবার শেষ দিনেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেলায় বেশ ভিড় ছিল। শেষ বেলায় এদিন বহু স্টলেই কার্যত ‘সেল’ দেওয়া হয়েছে। বহু স্টলের সামনে কর্মীদের দাঁড়িয়ে হেঁকে, ডেকে বাড়তি ছাড় ঘোষণা করতে দেখা গিয়েছে। বহু ক্রেতাই তাতে উৎসাহিত হয়ে পছন্দসই বই কিনে বাড়ি ফিরেছেন। গতবারের তুলনায় এবারে মেলায় ভিড় এবং বিক্রিবাটা বেশি হয়েছে। জানা গেছে, এবার বইমেলায় লোক এসেছেন ২৩ লক্ষ, বই বিক্রি হয়েছে ২১ কোটি টাকার।
মেলায় ভিড় নিয়ে সুধাংশুবাবু বলেন, এবারের মেলা গত বছরের তুলনায় একদিন কম হয়েছে। তাতেও ভিড়ের বহর কমেনি। গত বছর ২২ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন মেলায়। ২০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এবারে গত শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১৬ লক্ষ মানুষ মেলায় এসেছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত ১৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। মেলা শেষের পর দেখা যাচ্ছে, এবারের মেলায় ২৩ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন। মোট ২১ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী সুজিত বসু, সাধন পান্ডে। ছিলেন সুবোধ সরকার, সুজাতা সেন, শ্রীজাত, গায়ক সুরজিৎ–সহ অনেকেই। গিল্ডের ডিরেক্টর সুধাংশু দে বললেন, ‘আগামী বছর আরও ভাল ভাবে করার উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়ে গেল।’
গিল্ড সূত্রের খবর, এবারের মেলায় দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় নামে নদীয়ার চাকদহের বাসিন্দা এক শিক্ষক একাই ২ লক্ষ ৭২ হাজার টাকার বই কিনেছেন। বেশি টাকার বই কেনার কোনও পুরস্কার দেওয়ার কথা না থাকলেও, গতকাল মেলার শেষ দিনে তাঁকে সম্মান জানানো হয়। তিনি বলেন, বাড়িতে ১২ থেকে ১৪ হাজার বই ছিলই। এবারের কেনা বইগুলি এবার গুছিয়ে তুলতে হবে। গতকাল গিল্ডের পক্ষ থেকে লেখক এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদেরও পুরষ্কৃত করা হয়। পুরষ্কার পেয়েছে প্রতিক্ষণ, বৈভাষিক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দি বুকস। বিশেষ সম্মাননা পায় ‘জাগো বাংলা’ মঞ্চ।
এবার বইমেলার আয়োজকরা শুরু করলেন এক নতুন অধ্যায়। এবার থেকে প্রতি বছর বইমেলায় কোনও না কোনও জনজাতিকে বেছে নিয়ে তার প্রতিনিধিকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এবার দেওয়া হল লেপচাদের। পুরষ্কার নিয়ে লেপচা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বললেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের ভাষা, সাহিত্যের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেজন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ। গিল্ডের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হল লেখক প্রচেত গুপ্তকে। তিনি বললেন, প্রকাশকদের সঙ্গে বইও হেসেছে অলক্ষ্যে। যাঁরা বই ভালবাসেন, তাঁরা নিশ্চয়ই তা দেখেছেন। আবার মন্ত্রী সাধন পান্ডে গিল্ডের কাছে প্রস্তাব দেন, ‘বাংলায় অনেকে আছেন, যাঁরা লিখতে চান। তাঁদের স্ক্রিপ্ট আপনারা জমা নিন। বিশিষ্ট লেখকদের দেখান। নির্বাচনের পর বই ছাপা হোক। সরকার সাহায্য করবে।’
অন্যদিকে, বইমেলার শেষে খুশি মেলার আয়োজকরাও। কেন না, সমস্ত প্রকাশকই দিনের শেষে হাসিমুখেই বাড়ি ফিরেছেন। যেমন মঞ্চে বলছিলেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, সমস্ত প্রকাশকই কমবেশি একটু হেসেছেন। বইমেলা ঘিরে কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ মেলার ছন্দ কাটেনি। মেঘ করেছিল অবশ্য একটু। বৃষ্টি হয়নি। বইমেলার এবারের থিম ছিল গুয়াতেমালা। গুয়াতেমালার রাষ্ট্রদূত জিওভানি কাস্টিও ভাষণে তাঁর মুগ্ধতার কথা বললেন। জানালেন, ‘আমি আপনাদের বন্ধু হতে পেরে আনন্দিত।’ দেড়শো জন গরিব পড়ুয়ার হাতে বই এবং খাবার দেওয়া হল গিল্ডের তরফে।
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এ বছর ৪৩ বছরে পা দিল। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বইমেলার শিরোপা পেয়েছে এই মেলা। প্রতিবারই বিদেশ থেকে বহু নামী প্রকাশনা বইমেলায় তাদের সম্ভার বিক্রি করে। বইমেলার ক’দিনে গত এক বছরে কলকাতার অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের খবরাখবরও তাঁরা জেনে নেন। এবারও তার অন্যথা হয়নি। আবার এ বছর অনেক নতুন প্রকাশকও ঝকঝকে বই প্রকাশ করছেন বাংলা ভাষায়। তরুণ প্রজন্মের কাছে সে সমস্ত বই সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণের চেয়ে কোনও অংশেই কম নয়। পাশাপাশি সেই সমস্ত বাংলা বইয়ের বিক্রি এবং জনপ্রিয়তা এখন টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে। বলা যায়, এই বইপার্বণীর ক’দিনে বাংলা ভাষা আরও দীর্ঘতর হয়ে উঠল প্রতিটি পাঠকের মনে।