আজ সিএজি-র রিপোর্ট রাফাল চুক্তিকে ধোয়া তুলসীপাতা বলে শংসাপত্র দেবে এবং বিরোধীদের আক্রমণের সামনে তাকেই ঢাল করে প্রচারে নামা হবে— এই আশাতেই বুক বাঁধছিলেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। তবে তার আগেই রাফাল চুক্তির নতুন তথ্য ফাঁস হয়ে নতুন করে মোদী সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাকি লড়াই ‘চৌকিদার’-এর। কিন্তু রাফাল চুক্তি করার সময় শেষ মুহূর্তে দুর্নীতি ঠেকানোর শর্তই তুলে দেওয়া হয়েছিল! গোপন খবরটি ফাঁস করল ‘দ্য হিন্দু’।
গতকাল ফাঁস হওয়া নতুন তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি থেকে মোদী সরকার দুর্নীতি-বিরোধী শর্তই তুলে দিয়েছে। যার অর্থ, যদি দেখা যায় যে যুদ্ধবিমানের বরাত পেতে ফ্রান্সের দিক থেকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে, তার পরেও রাফাল চুক্তি বাতিল হবে না। এই ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে সরাসরি এক অ্যাকাউন্ট থেকে আর এক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে না। তার বদলে তৃতীয় একটি অ্যাকাউন্ট বা এসক্রো অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে। ফলে শুধু এই চুক্তিতে কত লেনদেন হচ্ছে, তার স্পষ্ট হিসেব থাকে। সেই শর্তও রাফাল চুক্তিতে মানা হয়নি।
সিএজি রিপোর্ট থেকে বেনিয়মের কোনও তথ্য সেভাবে প্রত্যাশা করছে না বিরোধীরা। তেমন কিছু তথ্য প্রকাশ করছে বরং ‘দ্য হিন্দু’। অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরক্ষার অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধের জন্য বেশ কয়েকটি নিয়ম হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও সংস্থা প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম বিক্রির সময় অবৈধ প্রভাব খাটাতে পারবে না। চুক্তিতে অনিয়ম ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জরিমানা দিতে হবে। সে সব তুলে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে ফরাসি সংস্থাকে ছাড় দিয়েছে মোদী সরকার। রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত নথি তুলে ধরে সোমবার ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনাবেচা প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়মাবলির ধার ধারেনি মোদি সরকার। মোটা অঙ্কের চুক্তির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা–সংক্রান্ত প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে। তা গুরুত্বই দেয়নি।
২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ফরাসি সংস্থা দাসো এভিয়েশন এবং এমবিডিএ ফ্রান্সের সঙ্গে ৫৮,৮৯১ কোটি টাকার বিনিময়ে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে মোদী সরকার। তার ঠিক একমাস আগে, আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। সেখানে দুর্নীতি বিরোধী জরিমানা শর্ত এবং এসক্রো অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেনের প্রক্রিয়া চুক্তিপত্র থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। (এসক্রো অ্যাকাউন্ট হল তৃতীয় কোনও পক্ষের অ্যাকাউন্ট, সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত যেখানে টাকা রাখা হয়।) সেইসঙ্গে বিমান সরবরাহ প্রক্রিয়া, অফসেট বরাত এবং সময়সূচি সংক্রান্ত মোট ৮টি বদলের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এরপর সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের নেতৃত্বে ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল (ডিএসি)-এর বৈঠক বসে। সেখানে যাবতীয় বদলে অনুমোদন দেওয়া হয়। তাতে সই করেন তৎকালীন ভাইস অ্যাডমিরাল অজিত কুমার। ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিলের সচিব ছিলেন তিনি। দ্য হিন্দুর দাবি, ফ্রান্সের সঙ্গে রাফাল নিয়ে দর কষাকষিতে নিযুক্ত থাকা উপদেষ্টা এম পি সিং, বায়ুসেনার ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজার এ আর সুলে এবং বায়ুসেনার যুগ্ম সচিব ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত ম্যানেজার রাজীব বর্মা এই পরিবর্তনে আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা উচিত। সতর্কতা বিসর্জন দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
আবার, বিমান সরবরাহে ব্যর্থ হলে ভারত সরকারকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ফ্রান্সের। সেই মতো ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দিতে হয়। কিন্তু দাসোকে সে ব্যাপারেও ছাড় দেওয়া হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, ‘লেটার অব কমফর্ট’ দিলেই চলবে, যা আইনত মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই ফরাসি কোম্পানির। ফরাসি প্রেসিডেন্টের তরফে চিঠি মারফত আশ্বস্ত করা হয়েছিল ৮ সেপ্টেম্বর। যার কোনও আইনি গুরুত্ব নেই। উল্লেখ্য, ভারত-সহ বিশ্বের নানা দেশে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত থাকে, যার মধ্যে অন্যতম হল দুর্নীতি বিরোধী জরিমানা শর্ত। যাতে দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে কোনও দালাল, সংস্থা বা প্রভাবশালীর ভূমিকা না থাকে। রাফাল কেনার জন্য সরাসরি ফ্রান্সের ওই সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর। প্রতিরক্ষামন্ত্রককে এড়িয়ে আলোচনা করার জন্য অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। দ্য হিন্দু–র আগের প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
এবার খবর, চুক্তি সই করার কিছুদিন আগেই ডিফেন্স প্রোকিওরমেন্ট প্রসিডিওর থেকে দুর্নীতি সংক্রান্ত ধারাগুলি শিথিল করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, কেন দুর্নীতির ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাতে কি আমাদের বায়ুসেনা কোনও ভাবে উপকৃত হয়েছিল? কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম সোমবার সকালে কয়েকটি টুইট করে বলেছেন, সরকার ভাবতেই পারেনি, রাফাল চুক্তির গোপন কথা এত তাড়াতাড়ি ফাঁস হয়ে যাবে। কংগ্রেসের দাবি, ফ্রান্সের দাসো কোম্পানি থেকে বেশি দামে ৩৬টি রাফায়েল বিমান কিনেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধু অনিল আম্বানি এই চুক্তির ফলে লাভবান হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বসপা নেত্রী মায়াবতী বলেছেন, ‘এক চৌকিদার-এর স্বার্থরক্ষায় দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা যায় না।’ মায়বতীর খোঁচা, ‘দুর্নীতি এবং দুর্নীতিপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি? অসুবিধে নেই। বিজেপি-সঙ্ঘের কাছে চৌকিদারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সততা নয়।’ নিজেকে সৎ সাব্যস্ত করতে সরকারি টাকায় সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন মরিয়া চৌকিদার, অভিযোগ বসপা নেত্রীর। মোদী বিরোধীতায় নতুন অস্ত্র পেয়ে রাহুল গান্ধী বলেন, ‘চৌকিদার নিজেই বায়ুসেনার থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি করার জন্য অনিল আম্বানিকে দরজা খুলে দিয়েছেন।’