কৃষ্ণ কিশোর না হয়ে তোর নাম বনবিহারী হলেই বোধ হয় ভাল হত। বাংলা তো বটেই দেশের প্রায় সব বনে জঙ্গলেই ছিল তোর স্বচ্ছন্দ ঘোরাফেরা। কত জঙ্গলে আমরা একসঙ্গে ঘুরেছি, ছবি তুলেছি। এ যাত্রায় আমাকে না নিয়ে তুই একাই এমন এক আঁধার অরণ্যে ঢুকে পড়লি যে তোকে আর দেখতেই পাবো না। এটা কী ঠিক হল? আমাদের ছেড়ে চলে গেলি তুই। সকালে তোর মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মনের পর্দায় ভেসে উঠছে আমাদের সেই জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘোরার ছবি।
সকালে তোর ৭৮এ বিবেকানন্দ রোডের বাড়িতে ঢুকে যে দৃশ্যটা দেখলাম, সত্যি তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পুরনো বাড়ির পাঁচতলার ঘরে থাকতিস তুই। বড় বড় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হত। একটু দূরেই ৫৯, বিবেকানন্দ রোডের সুপ্রিয় হালদারদের বাড়িতে থাকতাম আমি। কতবার তোকে ওপর থেকে ডেকে এনে চা, সিগারেট সহ শুরু হয়ে গেছে আমাদের বন জঙ্গলের আড্ডা। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। আমাকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হত, তোকেও নামতে হত সিঁড়ি ভেঙে। আড্ডার টানে সেসব ছিল তুচ্ছ। আজ সকালে তোর বাড়িতে ঢুকে সেই ছোট ঘরটাতে তোকে শুয়ে থাকতে দেখে সেসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তোর পিসি তোর হাত ধরে কেঁদে চলেছে, পায়ের কাছে একটা ছোট মেয়ে বসে মাঝেমধ্যে ঠিক করে দিচ্ছে মুখ ঢেকে ফেলা গলার মালাগুলো, কপালে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছিস তুই। মালাগুলো সরিয়ে যেন এখনই উঠে বলবি, কীরে কেমন আছিস? চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। প্রায় চার দশকের বন্ধু কে কে রায়কে কোনদিন এভাবে দেখতে চাইনি আমি। শেষদিকে যোগাযোগ একটু কমে গিয়েছিল, আগের মত অত ঘন ঘন দেখা হত না। এইতো মাস খানেক আগেও ফোন করে বললাম, কীরে কালী বেঁচে আছিস? তুই হেসে ফেললি। মৌ, কালী কেকে কত নামেই যে তোকে আমরা ডাকতাম! তবে কলকাতা তো বটেই দেশের বেশিরভাগ ফোটোগ্রাফারের কাছে কেকে নামটাই ছিল সবথেকে বেশি চেনা।
আমার মনে পড়ে গেল কাঠামবাড়ির ফরেস্টের এক ভোরবেলার কথা। ভোরে আমার ঘুম ভাঙিয়ে তুই বললি, অশোক, দেখতো আমার বোধহয় খুব জ্বর হয়েছে। তোর কাছে কোন ট্যাবলেট আছে? আজ আর বোধহয় বেরোতে পারবো না। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে থাকা ওষুধের বাক্স থেকে ট্যাবলেট বার করে তোকে দিলাম। দুপুর নাগাদ ঠিক হয়ে গেলি। আজ সকালে তোর কপালে হাত বুলিয়ে দেখলাম বরফের মত ঠাণ্ডা, আজ আর কোন ওষুধ কাজ করবে না। আমার থেকে প্রায় বারো বছরের বড় ছিলি তুই। জঙ্গলে ঘোরাফেরার সময় তুই, আমি আর দিলীপ তো থাকতামই, কখনও কখনও সঙ্গী হত আমাদের সতীর্থ আলোকচিত্রী বন্ধু� বিকাশ, কাজল, জয়ন্ত আর দেবাশিস। তুই আর আমি একসঙ্গে রাজ্যের কত জঙ্গল যে চষে ফেলেছি তা হিসেব করে বলা কঠিন। বন জঙ্গল ভালোবাসাটা ছিল তোর একটা ভেতরের ব্যাপার। আর এই ভালোবাসাটা তুই কত ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিস তুই নিজেই জানিস না। তোর উদ্যোগে আমরা কয়েকবার লঞ্চ ভাড়া করে বৌ, ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছি। আমাদের সবার বাড়ির লোকেদের কাছে তুই খুব পপুলার ছিলিস। বিয়েথা করিস নি বলে সবার বাড়ির লোকেদের কাছে এই ঘোরাফেরার সময় তোকে কত যে উপদেশ শুনতে হত তার ঠিক নেই। আমরা বন্ধুরাও একই কথা বলতাম। মুচকি হাসি ছাড়া তোর মুখে কোন দিন আর কোন জবাব শুনিনি। ঘোরাফেরার ব্যাপারে সবার বাড়ির লোক তোকেই ভরসা করতো সবচাইতে বেশি।
একবার বুনো হাতির ছবি তুলতে গিয়ে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে তুই আমি একসঙ্গে ছিলাম। রাতে দুজনে মিলে রাম খাচ্ছিলাম, রাম তোর আর আমার দুজনেরই খুব পছন্দের পানীয় ছিল তখন। তোকে জিজ্ঞাসা করলাম, শালা, আজ তোকে বলতেই হবে তুই কারো প্রেমে পড়েছিলিস কিনা? তুই গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলি � হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য। অবশেষে মাঝরাতে আমাকে শোনালি তোর প্রেমে পড়ার গল্প। যতদূর মনে পড়ছে সেই মেয়েটা ছিল গুজরাটি। তুই আমাকে পরে তোর সেই প্রেমিকার গলার একটা হার দেখিয়েছিলি। সেটা তুই সবসময় কাছেই রাখতিস। টুকরো টুকরো কত কথা মনে পড়ছে আমার। যেখানেই যাস �সকালে উঠেই দফায় দফায় পাঁচ-সাত কাপ লিকার চা তো তোর চাইই চাই। এক ফরেস্ট বাংলোয় বললো, অত সকালে চা দেওয়া যাবে না। ঘুম থেকে উঠে দেখি তুই নেই। ফিরলি বেশ কিছুক্ষণ পর। জিজ্ঞেস করতেই যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বললি, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে এলাম।
ছোটদের খুব ভালবাসতিস তুই। মুখে সিগারেট, কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ, সঙ্গে একগাদা ছোট ছেলেমেয়ে। কেকে বলতেই এখনও আমাদের অনেকের চোখে এই ছবিটা ভেসে ওঠে। আমার দু ছেলেই তোকে নামে চেনে। নিজের বাড়িতেও তোকে সবাই খুব ভালবাসতো। ভাই ও তাদের স্ত্রীরা, ভাইপো, ভাইঝিরা সবার কাছেই তুই ছিলি খুব প্রিয়। তাদের কাছে তুই ছিলি আদরের ছোটন। ছোটদের সঙ্গে চট করে ভাব করে ফেলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তোর মধ্যে। শুধু ছোটরা কেন, ছোট বড় কারও সঙ্গেই তোকে কোন দিন ঝগড়া করতে দেখিনি। কারো কোন কথায় কষ্ট পেলে মাথা নিচু করে গুম মেরে বসে থাকতিস। কোন আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী ছিলি না তুই। এই শিক্ষাটা তুই পেয়েছিলি পরিবার থেকে। তোর বাবা হিমাংশু বিকাশ রায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সরকারি তাম্রপত্র ও পেনশন পেয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বহু বিপ্লবী তোদের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। খুব সাধারণভাবে থেকে বড় কাজ করে যাওয়ার শিক্ষাটা তোর পরিবারের কাছ থেকেই পাওয়া। এই শিক্ষাটা তুই আজীবন মনে রেখেছিস।
ছোট বড় সবার সঙ্গেই সমানভাবে মেশার ক্ষমতা ছিল কেকের। রাজ্যের সব ফরেস্টের ডিএফও থেকে শুরু করে ফরেস্ট গার্ড, রেঞ্জার্স, বিট বাবু, পিএফ, সিএফ সবাই ছিল তোর বন্ধু। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গেছিস তুই। একইসঙ্গে তোর মনের সব জায়গাটুকু দখল করে রেখেছিল বন্ধুরা। একসময় সকালে ছবি তোলার ফাঁকে আমরা পিটিআইয়ে তোর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। উদ্দেশ্য একটাই, পাশের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের কচুরি, আলুরদম, দরবেশ,গজা, মিষ্টি সিঙাড়া, পান্তুয়া ইত্যাদি সাঁটানো। দিনের পর দিন কেকে যেন কিছুই হয়নি এভাবে আমাদের সবার খাওয়ার বিল মিটিয়ে দিয়েছে। একেকদিন সাত থেকে আটজনের বিল মেটাতি তুই। কোনদিন না গেলে বলতিস কীরে, আজ এলি না তো? আজ সকালে শ্মশানে আমাদের আলোকচিত্রী বন্ধুরা, বাড়ি ও পাড়ার লোক তোর এসব গুণের কথা যখন বলছিল তখন আমার মনে পুরনো সেসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
তোর বাড়ির লোকেরা বলছিল, গতকাল সরস্বতী পুজোর বাজারের ফর্দ করার সময় বলেছিলিস, আজ আমাকে দুটো কড়াপাকের সন্দেশ খাওয়াবি? একদম না করিস না কিন্তু? খিচুড়ি, কুলের চাটনি, পাঁপরভাজাও খাব। নিজের এটিএম থেকে টাকা তুলে দিয়ে বলেছিস, আজ পুজোর সব খরচ আমার। জীবনকে ভালবাসা যে মানুষটা শনিবার এতকিছু করল, রবিবার ভোরেই সে বিনা নোটিশে চলে গেল। এখনও সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে! মানুষ মরণশীল কথাটা আমরা সবাই জানি তবুও তা দিয়ে কি সব মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করা যায়! এক নবমীতে সুনীলদা চলে গেলেন, এবারের সরস্বতী পুজোয় তুই। পুজোর আনন্দের সঙ্গে কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে বিষাদ। গ্যাজেট আমাদের যোগাযোগ অনেক সহজ করে দিলেও আমরা সবাই যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি। এটা একটা বিপজ্জনক ব্যাপার। আসুন, আমরা সবাই একটু কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি অন্তত মনে মনে জুড়ে থাকতে। কেকের কিন্তু এই ব্যাপারটা একদম ছিল না। ও সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতো। সব বন্ধুরা মিলে একদিন কেকের একটা স্মরণসভার আয়োজন করলে কেমন হয়? জীবনকে এত নিবিড়ভাবে ভালবাসতে ভালবাসতে আচমকা যেন তার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল কেকে। এটা মানা যাচ্ছে না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )