সরকারিভাবে তিনি এখনও দলের মার্গ দর্শক। দল কোন পথে যাবে, কোন পথে গেলে তার ভবিষ্য সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হবে, তা স্থির করার ভার বর্ষীয়ান এই সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। তার পরেও দলের ভালো-মন্দ নিয়ে আশ্চর্যরকম ‘নীরব’ তিনি। নাকি তাঁকে ‘নীরব’ করে রেখেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব?
গত ৫ বছরে সব কটি অধিবেশন মিলিয়ে লালকৃষ্ণ আদবানী তথা বিজেপির লৌহপুরুষ মুখ ফুটে বলেছেন ৩৬৫ টি শব্দ। অথচ সংসদের অধিবেশনের দিনগুলিতে ৯২ শতাংশ হাজিরার মালিক নবতিপর প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী। ইন্ডিয়া টুডে-তে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট এবং লোকসভার বিভিন্ন অধিবেশনের নথি থেকে পাওয়া গেল আডবাণীর এই অবাক করে দেওয়া নৈঃশব্দের রেকর্ড।
এতেই প্রশ্ন উঠেছে, বরাবরের দাপুটে এই নেতা মোদী-শাহের আমলে এমন ‘চুপ’ কেন? তবে কী মোদী-শাহের অঙ্গুলিহেলনেই চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছেন লৌহপুরুষ? শাসক দলে থাকুন বা বিরোধী দলে, আডবাণীর সরব উপস্থিতি দশকের পর দশক চাক্ষুষ করেছে সারা দেশ। যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী, তখন বিরোধীদের আক্রমণ ভোঁতা করতে শাসক দলের মূল কাণ্ডারি ছিলেন তিনিই। আবার যখন ইউপিএ ক্ষমতায় আর প্রধানমন্ত্রিত্বে মনমোহন, তখন শাসক দলকে নাকাল করতে বিরোধী শিবিরের মূল সেনাপতি ছিলেন তিনিই। ২০১৩ সালেও একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস শিবিরকে সংসদে কার্যত কোণঠাসা করে দিয়েছিল আডবাণী ব্রিগেড। পঞ্চদশ লোকসভার সেই উজ্জ্বল উপস্থিতির পরই ষোড়শ লোকসভায় আডবাণীর এই হঠাত্ নৈঃশব্দ শুধু বিজেপি নয়, ভারতীয় সংসদের কাছেও বোধহয় ‘অস্বস্তিকর’।
লৌহপুরুষের আর কিছু বলার নেই বা তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছে বা তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ, এই অজুহাত বোধ হয় ধোপে টেকে না । কারণ, নিজের আত্মজীবনী ‘আমার দেশ, আমার জীবন’-এ প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বেশি লিখেছেন তিনি, যা থেকে স্পষ্ট, এখনও অনেক কিছু বলার আছে আডবাণীর। লোকসভায় তাঁর উপস্থিতি থেকেও পরিষ্কার, বয়সের কারণে তিনি চুপ হয়ে আছেন, এই বক্তব্যও সঠিক নয়। ২০১৪-২০১৯, এই পাঁচ বছরে ১৬টি অধিবেশনে মোট ৩২১ দিন বসেছিল লোকসভা। তার মধ্যে ২৯৬ দিন হাজির ছিলেন আডবাণী। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে ৯২.২ শতাংশ, যা যে কোনও সাংসদের কাছেই রীতিমতো ঈর্ষাজনক।
কিন্তু কেন নীরব হয়ে গেলেন বিজেপির বহু যুদ্ধের সেনাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী। দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের পর তাঁর দল এখন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। বিজোপির এখন প্রশ্নাতীত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লোকসভায়। সেই সোনার সময়েই নীরব হয়ে গেলেন লৌহপুরুষ?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতেই আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটা উপস্থিত আডবাণী এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার শুরু। বিজেপির ফেসবুক পোস্টে ২০১৯ সালে এক বারের জন্যও আডবাণীর নামোল্লেখ নেই। ২০১৮ সালে মাত্র দু’বারের জন্য তাঁর নাম উল্লেখ করেছে বিজেপি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও তাঁর এই হারিয়ে যাওয়ার শুরু ২০১৪ সাল থেকেই। ২০১১ সালে সংখ্যাটা ছিল পঁচিশ, ২০১২ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় একুশে। ২০১৩ সালে মোট ৪৩ বার আডবাণীর নামোল্লেখ করা হয়েছিল বিজেপির ফেসবুক পোস্টে। ২০১৪ সালে মাত্র তিন বার, ২০১৫ তে চার, ২০১৬ তে এক এবং ২০১৭ সালে সারা বছরে বিজেপির কোনও পোস্টে কোনও উল্লেখ নেই আডবাণীর। অর্থাৎ মোদী-শাহ মাঠে নেমেই লৌহপুরুষকে সাইডলাইনের ধারে ঠেলতে শুরু করেছেন সেটা স্পষ্ট।
