ইতিহাস বলে প্রথম লেখার প্রাচীনতম নিদর্শন হল প্যাপিরাসের ছালে লেখা লিপি। সেখান থেকেই কালের নিয়মে এগিয়ে এসে, এখন কাগজে লেখা বই। তবে ই-বুক নয়, হাতে স্পর্শ করা যায়, যার গন্ধ নেওয়া যায় এমন বই-এর প্রতি ভালোবাসা কলকাতাবাসীর আগাগোড়াই বেশি। তাই কেবল মনের টানে, বইমেলায় আসেন মানুষ।
বইমেলায় মাইকে বাজছে “বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে”, আর হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে আগত বসন্ত হাওয়া। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন হলেও মেলায় ভীড় কিন্তু কম নেই৷ যেসব মানুষ এসেছিলেন তাঁরা বইয়ের টানেই এসেছিলেন। পছন্দের স্টলে ঢুকে মন ভরে দেখে নিচ্ছেন এবং কিনছেন অজানা বই গুলো।
মঙ্গলবার দুপুরে এসবিআইয়ের স্টলে চলছে মাইক্রোফোনে লেটেস্ট ব্যাঙ্কিং পরিষেবার খুঁটিনাটি । তার কানঘেঁষে ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্টের স্টল। সেখানে মাইক্রোফোন হাতে দুই তরুণী ঘাম ঝরাচ্ছিলেন তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত বিভিন্ন যন্ত্রের জনজীবনে উপকারিতার বর্ণনায়। ঢিলছোঁড়া দূরত্বে জাগো বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে তখন একতারা হাতে নেচে নেচে বাউলের তোমায় হৃদমাঝারে রাখার প্রবল ইচ্ছে। সব মিলিয়ে মঙ্গলবারের দুপুরে বইমেলায় এক অদ্ভুত ফিউশন।
এবারের মেলায় পুরনো বইয়ের চাহিদা কিছু কম নয়। জনপ্রিয় বেশ কিছু বই। সেগুলো হল, সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত মহানায়ক উত্তমকুমারের লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি’ এবং ‘নায়কের কলম’।এবারের নতুন বইয়ের সম্ভার থেকে রবি ঘোষের ‘আপন মনে’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চরিত্রের সন্ধানে’, অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও অমিতাভ চৌধুরির ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ ইতিমধ্যেই স্টক শেষের মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলেছে। স্টক শেষের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে অভিযান পাবলিশার্স প্রকাশিত বাংলাদেশের লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’। ব্যাপক জনপ্রিয় শান্তনু চক্রবর্তীর সিনেমা–বিষয়ক বই “এক ছিলিম ফিলিম”। অভিযান থেকেই মিলছে বাংলাদেশের রাত্রি প্রকাশনীর কিছু বই। তার মধ্যে সাড়া ফেলেছে ওদেশের কবি দেবাশিস সান্যালের ‘প্রেম দ্রোহ রক্তক্ষরণ’। পাঠকের সিধুর লেখা বইটির প্রতি আগ্রহ যে বেশি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বইটির নাম “নাম সিধু পদবী ক্যাকটাস”।
মঙ্গলবার সারাদিনই পত্রভারতী ছিল জমজমাট। অবনী দাসের ‘থ্রিলার’–এর খোঁজে স্টলে এসেছেন কয়েকশো মানুষ। প্রকাশকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘হারিয়ে যাওয়া লেখা’, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তর ‘অপরাজেয়’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘সিন্ধুক খুললেই চল্লিশ’ এবং ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় ও হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তর ‘শশাঙ্ক’। এদিন সন্ধেয় পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত হল মৌ রায়চৌধুরির কবিতার বই ‘মন খারাপের কোলাজ’। চাঁদের হাটে ছিলেন সত্যম রায়চৌধুরী, ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি, রেখা চট্টোপাধ্যায়, জয়ন্ত ঘোষ, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত, দেবদূত রায়চৌধুরী প্রমুখ। দুপুরে প্রেস কর্নারে নজরুল ইসলাম বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল নজরুল আকাদেমি। বক্তব্য পেশ করেন জয় গোস্বামী, নজরুল গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত, কল্যাণী কাজী প্রমুখ। তারপর প্রেস কর্নারে প্রকাশিত হয় জোনাকি মুখার্জির ‘রাঙা ধানের গান’। হাজির ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি মিশ্র, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অলকানন্দা রায়।
মেলায় আসা মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছে থিম কান্ট্রি গুয়াতেমালার প্যাভিলিয়ন। যা কিছু অজানা সেসব জানবার তাগিদে বার বার ছুটে গেছেন রংদার মিনি–গুয়াতেমালার দিকে। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের চিরকালীন তুমুল আড্ডা জোনে বারেবারেই ফিরে এসেছেন দিব্যেন্দু পালিত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী ঠাকুরের স্মৃতি।
লেখার থেকে পড়ার এক আত্মিক যোগ হয়েছে যবে থেকে, তবে থেকেই এই ভালোবাসার জন্ম। আর বই তো একটা অভ্যেস, সেই অভ্যেসের তাদিগেই ফিরে ফিরে আসা। আদতে হাতের সামনে যতই ইউটিউব, ইন্টারনেট, পিডিএফ থাকুক, বইপ্রেমী মানুষ চান বাড়িতে প্রিয় বইয়ের এক বড়োসড়ো সেলফ। তাই ভালোবাসার টানে এই বইমেলাতে ফিরে ফিরে আসা।