কথায় বলে রেকর্ড তৈরিই হয় নাকি ভাঙার জন্য। ঠিক তেমনটাই ঘটল এবার। মোদীর ঘনিষ্ঠ হীরে ব্যবসায়ী মেহুল চোকসি এবং নীরব মোদী পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে প্রতারণা করে মাত্র ৫০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। মাত্র ৫০০০ কোটি! তবে সদ্য খোঁজ পাওয়া এক জালিয়াতির অঙ্ক ৩১ হাজার কোটি টাকা! যা আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি।
দেওয়ান হাউজিং ফিনান্স লিমিটেড বা ডিএইচএফএল নামে পরিচিত গৃহঋণ সংস্থাটি একাধিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ওই বিপুল পরিমাণ টাকার সিংহভাগ, প্রায় ২১ হাজার কোটি পাচার করেছে ভারতের বাইরে কিছু ভুয়ো সংস্থায়। ঋণ হিসেবে ওই টাকা দেওয়া হয়েছে তাদের, সে ঋণ শোধ দেওয়ার ইচ্ছে বা সামর্থ্য, কোনওটাই যাদের নেই। বাকি ১০ হাজার কোটি ধার দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশীয় সংস্থাকে। এর মধ্যে গুজরাট এবং কর্ণাটকের কিছু সংস্থা আছে, যারা ঋণ পেয়েছে ওই দুই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে।
এ ছাড়া আলাদা করে ২০ কোটি টাকা ডিএইচএফএল-এর অধীন সংস্থাগুলি ‘দান’ করেছে বিজেপির তহবিলে। তার মধ্যে ১৯.৬ কোটি টাকার নির্দিষ্ট হিসেব পাওয়া যাচ্ছে ওই সংস্থাগুলির দাখিল করা জমা-খরচের হিসেবে। আর ৯.৯৩ কোটি টাকা দানের কথা চেপে গিয়েছিল আর কে ডেভেলপার্স নামে ডিএইচএফএল-এরই একটি সংস্থা, কিন্তু তাও ধরা পড়ে গেছে।
সংবাদ সংস্থা ‘কোবরাপোস্ট’ এই আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস করেছে যে সব নথিপত্র ঘেঁটে, তার কিছুই গোপন ছিল না। সবই প্রকাশ্য এবং সুলভ ছিল। তাও ৩১ হাজার কোটি টাকার এই কেলেঙ্কারির কোনও হদিশ পায়নি ইডি বা অন্য কোনও আর্থিক নজরদার সংস্থা! এবং যথারীতি এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আদতে সাধারণ মানুষের পকেট কেটেই নেওয়া হয়েছে, যেহেতু তা ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থ।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাঙ্কগুলির তালিকায় সবার ওপরে আবারও পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক। সেই সঙ্গে আরও ৩ সরকারি ব্যাঙ্ক। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা এবং ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। যারা আগে থেকেই অনাদায়ী ঋণ, অনুৎপাদক সম্পত্তি এবং ব্যবসায় মন্দা নিয়ে জেরবার। যে সব বেসরকারি ব্যাঙ্ক ডিএইচএফএলকে ঋণ দিয়ে ফেঁসেছে, তারা হল অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক, কোটাক, এইচডিএফসি এবং আবারও সেই আইসিআইসিআই।
এই খবর ফাঁসও হল এমন এক সময়ে, যখন আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের পদত্যাগী প্রধান ছন্দা কোছর ও তাঁর স্বামীর নামে সিবিআই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। নিয়ম ভেঙে, নিজেরা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভিডিওকন শিল্পগোষ্ঠীকে ৩২৫০ কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ এঁদের বিরুদ্ধে। এই দুর্নীতির শরিক, ভিডিওকন গোষ্ঠীর প্রধান বেণুগোপাল ধুতের নামেও চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। তবে এঁদের তিনজনে যে টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তার প্রায় ১০ গুণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ডিএইচএফএল।
দেশের অর্থনৈতিক মহলের অভিমত, সাম্প্রতিকতম এবং ভারতের ইতিহাসে বৃহত্তম এই কেলেঙ্কারি সামগ্রিক ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ সাধারণ ভাবে কোনও সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার সময় শুধু সেই সংস্থার স্থাবর সম্পত্তিই ঋণশোধের গ্যারান্টি হিসেবে রাখা হয় না, সংস্থার মালিকেরাও ব্যক্তিগত সামর্থ্যে গ্যারান্টার থাকেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এমন সংস্থাকে ঋণ দিয়েছিল ডিএইচএফএল, যে সংস্থার গ্যারান্টি দেওয়ার মতো কোনও সম্পত্তিই নেই। তাদের মালিকেরাও আর্থিক সামর্থ্যে নগণ্য, ঋণশোধের ক্ষমতা নেই তাঁদেরও।
বিরোধীরা বারবারই এই অভিযোগ করে থাকেন যে, মোদীর আমলে ‘আচ্ছে দিন’ এসেছে আম্বানি-আদানিদের মতো দেশের ধনীদের এবং মালিয়া-চোকসিদের মতো প্রতারকদের। এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তাদের সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিচ্ছে। বিরোধীদের কারও কারও কটাক্ষ, মোদী জমানায় দেশের গরীব মানুষদের আর্থিক বিকাশ না হলেও, আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে হাজার হাজার কোটির।