বিতর্কের সূত্রপাত ফরাসি সেনেটে ২০১৫ সালের ২৪ জুন হওয়া এক আলােচনার নথিপত্র। যা থেকে উঠে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য, যে রাফাল চুক্তির নিয়ম আড়াল করতে আদালতে মিথ্যা বলেছিল মোদী সরকার! ওই আলোচনার নথিপত্র দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, সম্পূর্ণ একার ইচ্ছায় ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ২০১৫ এপ্রিলে তাঁর প্রথম ফ্রান্স সফরের পরই।
সুপ্রিম কোর্টে রাফাল মামলার শুনানিতে সরকার জানিয়েছিল, ইউপিএ আমলে ১২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার ‘রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল’ প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৫ মার্চে। সে বছর জুনে সেটি প্রত্যাহৃত হয়। তারিখ ও স্বাক্ষরহীন সরকারি নোটে সর্বোচ্চ আদালতকে এই ভুল তথ্য দেওয়াই হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এপ্রিলের ঘোষণাকে বৈধতা দিতে। কিন্তু ১০ জুন ২০১৫ ফ্রান্সের সিনেটে বিদেশ, প্রতিরক্ষা ও সামরিক বাহিনী বিষয়ক কমিটিতে আলোচনায় পরিষ্কার নথিভুক্ত যে ভারতের ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়াই হয়েছে এপ্রিলে, মোদীর ফ্রান্স সফরের সময়।
২৪ জুনের সেনেট বৈঠকে দাসাে অ্যাভিয়েশনের সিইও এরিক ট্রাপিয়েরের কথায় স্পষ্ট হয়ে যায়, ইউপিএ আমলের ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি তখনও বাতিল হয়নি। বরং দাসো-প্রধানের তখনও জানেন, ৩৬টি বিমান কেনার কথা বলেছেন মোদী। এবং আরও ৯০টি বিমান কেনার বরাতও শিগগিরই আসবে। বৈঠকে এই আলোচোনাও হয় যে ভারত সরকার তাদের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচী সফল করতে, রাফাল বিমান তৈরির কাজ ভারতে গিয়ে করতে চাপ দিচ্ছে।
কিন্তু ১২৬টি বিমান নিয়েই ফ্রান্স তখনও আশাবাদী, কারণ ভারত তার জরাজীর্ণ বিমান বাহিনীর খোলনলচে বদলে ফেলতে চায়। এবং তা করতে পুরো ৬ স্কোয়াড্রন অর্থাৎ ১২৬টি বিমানেরই প্রয়োজন ছিল ভারতের। অর্থাৎ ভারতীয় বিমান বাহিনীর জরুরি প্রয়োজন মেটাতেই দ্রুত সিদ্ধান্তে ৩৬টি বিমান কেনার দাবিটিও ঠিক নয়। আর ইউপিএ আমলে যে বিমান কেনা হচ্ছিল, আর মোদী এসে যে বিমান কিনলেন, দুটোই অবিকল এক ধরনের বিমান।
প্রশ্ন উঠতেপারে, কী করে নিশ্চিতভাবে এটা বলা যাচ্ছে? বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যেখানে রাফাল যুদ্ধবিমান সম্পর্কিত সব তথ্য গােপন রাখা হচ্ছে। সরকার এই যুক্তি সুপ্রিম কোর্টে দিয়েছে যে শত্রুপক্ষ দাম শুনে বুঝে ফেলবে, কি ধরনের অস্ত্র শস্ত্র সমেত এই বিমান কিনছে ভারত। কাজেই রাফাল যুদ্ধবিমানের দাম জানানো যাবে না। আদালত সেই যুক্তি মেনেও নিয়েছে। কিন্তু রাফাল-এর নির্মাতা দোসোর ওয়েবসাইটে গেলেই জানা যাবে, ভারত যে বিমানটি কিনছে তার সামরিক সক্ষমতা ঠিক কেমন। কোন ধরনের অস্ত্র থাকবে তাতে।
ওই ওয়েবসাইটে চোখ বোলালে একইসঙ্গে এও জানা যাবে যে, যখন ভারত বরাত দেওয়া যুদ্ধবিমানগুলো শেষ পর্যন্ত হাতে পাবে, ততদিন আধুনিকতর এবং উন্নততর রাফাল যুদ্ধবিমান বাজারে এসে যাবে। অর্থাৎ তথাকথিত শত্রুপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার দাবিও কার্যত ধোপে টিকবে না। অন্যদিকে, ফ্রান্স থেকে রাফাল-প্রযুক্তি ভারতে হস্তান্তরিত হবে বলে যে প্রচার, তাও ঠিক নয়। বরং ভারত এবং ফ্রান্স, দুই সরকারের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে স্রেফ এইটুকু নিশ্চয়তা দেওয়া আছে যে সময় মতাে ভারতকে বিমান সরবরাহ করা এবং তাদের গুণগত মান ঠিক রাখার গ্যারান্টি দিচ্ছে ফরাসি সরকার। কিন্তু যদি বিমানের কোনও যন্ত্রাংশ ঠিক সময়ে তৈরি হয়ে না আসে, তাহলে তার দায়িত্ব ফ্রান্স নেবে না। ফলে সেনেটের এই আলোচনার নথিপত্র দেখলেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাফাল নিয়ে আগাগোড়া মিথ্যে বলছেন মোদী।