লেখনী শুরু করলাম একটি সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এ একটি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস অসংরক্ষিত আসন ১৩২ টি, প্রত্যেক বছর ১৩২ এর মধ্যে কমপক্ষে ১০০ জন রাজ্য বোর্ড এর ছাত্র ছাত্রী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এ সুযোগ পেতো| ২০১৭ এর সর্বভারতীয় নীট এর সৌজন্যে আজ সেই সংখ্যাটি শূন্য, হ্যা একদম ঠিক শুনছেন | ভাবতেও অবাক লাগে আমাদের রাজ্যে এরকম দিন এসে গেছে | যে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বাংলা ও দেশের গর্ব, যে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বাংলা ও দেশের জন্যে বহু দিকপাল ডাক্তার এর জন্ম দিয়েছে, সেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ আজ(২০১৭ এর নীট এর ফলাফল অনুযায়ী) রাজ্য বোর্ডের একজন ছাত্রছাত্রীও নেই |
২০১৭ এর নীট এর ফলাফল অনুযায়ী মাত্র ৭% ছাত্র ছাত্রী ছিল রাজ্য বোর্ড থেকে সুযোগ পেয়েছে | অথচ ২০১৬ সালে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল, মেডিক্যাল এ ৭৫% ছাত্র ছাত্রী ছিল রাজ্য বোর্ড এর | প্রশ্ন তাহলে হল এরকম কেন হল? কারণ গোটা ভারতের জন্য অভিন্ন মেডিক্যাল এন্ট্রান্স, প্রশ্ন করে সিবিএসই | সিবিএসই বোর্ড এর ছেলেমেয়েরাই অধিকাংশ সুযোগ পায় মেডিক্যাল এ| প্রশ্ন হল এই সিবিএসই বোর্ড এ কারা পড়াশোনা করে? সিবিএসই বোর্ড এ সাধারণত শহরের উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে| সিবিএসই বোর্ড এ পড়ার জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা গ্রাম এর সাধারণ পরিবার এর ছেলেরা কোথা থেকে পাবে ? গ্রাম এর মানুষের একমাত্র ভরসা হল রাজ্য বোর্ডের স্কুল| শিক্ষা কি তাহলে শুধু শহরের উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের অধিকার? অবস্থা এমন যে লোকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে রাজ্য বোর্ড এ পড়াশুনা করে কোনো লাভ নেই| আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আজ সামান্য অবস্থাপন্ন অভিভাবকরা নিজেদের ছেলেমেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এই পড়ায়, কলকাতা শহর ও শহরতলিতে এই মানসিকতা বিগত ২০-২৫ বছর ধরেই চলছে, এখন মফস্সল ও জেলাতেও এই মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে|
রাজ্য বোর্ডের ছাত্র ছাত্রীদের স্বপ্নের অপমৃত্যুর দায় কার? রাজ্য বোর্ড পরীক্ষা নিলে, সিবিএসইর তথাকতথিত মেধাবীদের সাথে লড়াই করেই তো ৭৫% হয় তারা।রাজ্য বোর্ড তথা গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়েদের মেধা কমে গেছে বা তারা পরিশ্রমী নয়, এ গল্প ধোপে টেকে? কিন্তু সিবিএসই পরীক্ষা নিলে চিত্রটা পুরো আলাদা। ৭৫% থেকে সংখ্যা নেমে আসে ৭% এ কারণ নীট এর পরীক্ষার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা, গ্রাম এর সাধারণ ছেলে মেয়েদের জন্যে যা শক্ত |
এবার আসা যাক আমাদের রাজ্যের ভ্রান্ত ডোমিসাইল নীতির ব্যাপার এ| ডোমিসাইল নীতি কি এই ব্যাপার এ আগে বলে নেওয়া যাক, ডোমিসাইল নীতি হল সেই নীতি যার মাধ্যমে যে ছাত্র ছাত্রী যে রাজ্যের বাসিন্দা সেই রাজ্যে তার অগ্রাধিকার পাওয়ার নীতি | ডোমিসাইল নীতি ২ রকম এর হয়, ডোমিসাইল A এবং ডোমিসাইল B | ডোমিসাইল A শংসাপত্র পেতে গেলে সেই ছাত্র অথবা ছাত্রী টি কমপক্ষে ১০ বছর সেই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে এবং তাকে রাজ্যের কোনো বিদ্যালয় থেকে ১০+২ বোর্ড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে | ডোমিসাইল B শংসাপত্র পেতে গেলে সেই ছাত্র অথবা ছাত্রী টি সেই রাজ্যের বাইরে শেষ ১০ বছর থাকে কিন্তু তার বাবা অথবা মা এর কোনো একজন যদি ওই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হন, তাহলেও সেই ছাত্র অথবা ছাত্রী টি ডোমিসাইল B শংসাপত্র এর যোগ্য | পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া প্রত্যেকটি রাজ্যে ডোমিসাইল A নীতি চলে কিন্তু আমাদের রাজ্যে চলে ডোমিসাইল B | অর্থাৎ ছাত্র অথবা ছাত্রী টি আমাদের রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও রাজ্য ডোমিসাইল কোটা(৮৫%) এর মধ্যে পড়বেন |
এছাড়াও লোকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নামি দামি কোচিং সেন্টারের ধারণা | শহরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই আকাশ এর মতো কোচিং সেন্টারে নীট এর প্রস্তূতি নেয়, যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়, গ্রাম এর দরিদ্র মানুষের এর কাছে যা আকাশকুসুম কল্পনা |
যে গ্রাম বাংলা থেকে এতো বড় বড় ডাক্তার উঠে এসেছে, সেই গ্রাম বাংলা এর ছেলে মেয়েরা সর্বভারতীয় নীট, ভ্রান্ত ডোমিসাইল নীতি, নামি দামি কোচিং সেন্টার এর রমরমা এর কারণ এ ধীরে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন ছেড়ে দিচ্ছে | গ্রাম বাংলা থেকে ডাক্তারি তে সুযোগ পাওয়া এখন অলীক স্বপ্ন হয়ে গেছে | এমন দিন আসছে যেখানে গ্রাম বাংলায় একটা ডাক্তার এ খুঁজে পাওয়া যাবে না | গ্রাম বাংলায় চিকিৎসা করার একটা ডাক্তারও থাকবে না | ক্ষতি হবে গ্রাম বাংলার কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের যাদের সামর্থ্য খুব সামান্য |
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )