‘তুমি ঠিক আছো তো?’ – কলকাতা থেকে প্রথম ফোনটা পেলাম অরূপের, আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু, অধুনা পাটুলি অঞ্চলের কৃতী পুরপিতাও বটে। শিলচরের রিয়া প্যালেস হোটেলের বাইরে তখন আমার নামের ‘মুর্দাবাদ’ স্লোগান আর ঢিল দিয়ে কাচ ভাঙা, দুইই চলছে। ভিতরে আমাকে আগলে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, বিশেষত মহিলারা। আর তাঁদের জোর দেখে, ভরসা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি ওই অত বিপদের মধ্যেও।
ভেবেছিলাম কলকাতা অবধি নিশ্চয়ই পৌঁছবে না এই বিক্ষোভের খবর, তাই দূর্বা বা মা’কে ফোন করে জানাইনি কিছু। আমার ধারণা ছিল না, বিষয়টা ফের এত বড় আকার নেবে। কাল সন্ধে থেকে রাত অবধি ঠিক কী কী হয়েছে আর কোন অবস্থায় তার মধ্য থেকে ফিরেছি, এতক্ষণে কাগজে কাগজে, চ্যানেলে চ্যানেলে তা চাউর হয়ে গেছে। তা বলার জন্য এই লেখা নয়। অন্ধকারের কথা যত কম বলা হয়, ততই ভাল।
আলোর কথা বলার জন্যই এই লেখা। যে-আলো কাল শীতের রাতে শিলচরের অন্ধকারের মধ্যেও আমায় পথ দেখাল, সেই আলো। শিলচরের বাসিন্দা যেসব মানুষ আমাকে সারা সন্ধে বুক দিয়ে আগলে রাখলেন, তাঁদের আলো। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে প্রতি মুহূর্তে যাঁরা ফোন করলেন, ছুঁতে চাইলেন, জানাতে চাইলেন পাশে থাকার কথা, তাঁদের আলো। প্রবাসী বন্ধুদল থেকে প্রাক্তন সহকর্মী, লেখালেখি, গানবাজনা, ছায়াছবি, থিয়েটারের এত এত স্বজন, আর তাঁদের পাশে একেবারে নাম-না-জানা দূরের মানুষজন, যাঁরা জানালেন সমর্থন, তাঁদের সব্বার আলো।
সার্কিট হাউসে যখন সরানো হচ্ছে আমায়, ফোন পেলাম শ্রী অরূপ বিশ্বাসের। ততক্ষণে সব তথ্য কলকাতার সকলের জানা। মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিমের তরফে কথা বললেন তাঁর এক প্রতিনিধি। সার্কিট হাউসে ঢুকছি যখন, অস্ফূট একটি নম্বর থেকে ফোন। ধরতেই দু’বছর আগের একখানা চেনা প্রশ্ন, একই কণ্ঠস্বরে – ‘কী হয়েছে আমাকে বলো তো? এখন ঠিক আছে সব?’ মুখ্যমন্ত্রী ফোন করছেন কলকাতা থেকে। অস্বস্তি হল এই ভেবে যে, বারবার আমার কারণে ব্যতিব্যস্ত হতে হচ্ছে তাঁকে। আর স্বস্তি পেলাম এই কারণে যে, প্রতিদিনের কোনও সংযোগ বা সম্পর্ক ছাড়াই, বিপদ দেখলে পাশে দাঁড়াতে দেরি হচ্ছে না তাঁর। বিশদে জানলেন সমস্তটা, আশ্বস্ত করলেন, আর কোনও অসুবিধে হবে না। ফোন রাখার আগে বললেন, ‘এবার থেকে কোথাও গেলে একটু জানিয়ে যেও, কেমন?’ শেষের এই বাক্যটির মধ্যে যে আটপৌরে গার্হস্থ্য উদ্বেগ জড়িয়েছিল, আজকের রাজনীতিতে তার দাম কম নয়।
সশস্ত্র বাহিনী আমাকে আগলে রাখল সারা রাত, পৌঁছে দিল বিমানবন্দরে। কলকাতায় নামার পরও দেখি একই ব্যবস্থা। দু’দিন ইন্টারনেট থেকে দূরে ছিলাম, আজকাল মন্দ লাগে না। বাড়ি এসে ফেসবুক খুলতেই দেখি কত বন্ধু তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন এই ঘটনার প্রতিবাদে, কতভাবে। ভালবাসা আর জোর জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন কত মানুষ। কেবল এঁদের সক্কলের ঋণ স্বীকার করার জন্যই এই লেখা। আর কিছু নয়।
এই যে এত অন্ধকার চারপাশে, তার মধ্যে এঁরা প্রত্যেকে নানারঙের আলো হয়ে আমাকে পার করে দিলেন বিপদের এক সুড়ঙ্গ, আজকের দুর্দিনে এর চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারে? তাঁদের প্রত্যেককে আমার কুর্নিশ, কৃতজ্ঞতা। হ্যাঁ, শূন্যতায় ভরে উঠছে চারপাশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে, সে-কথা জানলাম, নতুন করে।
সৌজন্য – কবি শ্রীজাতর মুখবইয়ের দেওয়াল