সিনেমার গল্পের ছোঁয়া এবার বাস্তবেও। সম্প্রতি ‘দৃশ্যম’ নামক একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে দেখা গিয়েছিল এক খুনের ঘটনায় তদন্তের মোড় অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য কুকুর মেরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল ছবির অভিনেতা অজয় দেবগন ওরফে বিজয় সালগাওকর। সিনেমায় নিহত যুবক ছিলেন গোয়া পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল-এর (আইজি) ছেলে। তিনি নিজে এবং গোয়া পুলিশের গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত চালিয়েও সেই খুনের কিনারা করতে পারেননি। উদ্ধার হয়নি মৃতদেহ। বিজয় সালগাওকরকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
রিলের এই দৃশ্য প্রায় হুবহু নকল করে ইন্দোরে টুইঙ্কল দরগে নামে বছর বাইশের এক তরুণীকে খুন করা হয়েছিল। কিন্তু ‘রিয়েল লাইফ’-এ ইন্দোরের বিজেপি নেতা জগদীশ কারোতিয়া ওরফে কাল্লু পেহলওয়ানের (৬৫) সৌভাগ্য হয়নি বিজয় সালগাওকরের মতো। যদিও পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, ‘দৃশ্যম’ সিনেমা দেখেই অভিযুক্ত জগদীশ খুন করেছিলেন ওই তরুণীকে। শেষ পর্যন্ত দু’বছর তিন মাস পর পুলিশের জালে জগদীশ। সঙ্গে তাঁর তিন ছেলে অজয় (৩৬), বিজয় (৩৮), বিনয় (৩১) এবং নীলেশ কাশ্যপকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইন্দোরের বনগঙ্গা এলাকার বাসিন্দা টুইঙ্কেলের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন জগদীশ। বেশ কিছুদিন সম্পর্ক চলার পর বিবাদ শুরু হয় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। ওই সময় জগদীশকে বিয়ে করতে বলেন টুইঙ্কেল। কিন্তু তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে সংসার করা জগদীশ তাতে রাজি হননি। অন্যদিকে, টুইঙ্কেলও নিজের দাবিতে অনড় ছিলেন। পুলিশের দাবি, সম্পর্কের এই টানাপড়েনের জেরে নিজের পরিবারে অশান্তি এড়াতে টুইঙ্কেলকে খুনের পরিকল্পনা করেন জগদীশ।
কেমন ছিল সেই পরিকল্পনা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই উঠে এসেছে রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে ধৃতরা জানিয়েছেন, ওই ঘটনার আগে তাঁরা দৃশ্যম ছবিটি দেখেন। অবশেষে ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর টুইঙ্কলকে প্রথমে গলা টিপে খুন করেন। দেহ পুড়িয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন অভিযুক্তরা। তার পর তদন্তের মোড় ঘোরাতে একটি কুকুর মেরে ওই এলাকার একটু দূরে একটি জায়গায় মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়।
ইন্দোরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) হরিনারায়ণাচারী মিশ্র বলেন, ‘যেখানে কুকুরটি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল, সেই এলাকায় অভিযুক্তরাই রটিয়ে দেন, কাউকে খুন করে ওই মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। সেই সূত্রে ওই জায়গায় খোঁড়াখুড়ি করে পুলিশ ওই কুকুরটির দেহাংশ ছাড়া কিছুই পায়নি।’ কিন্তু তাতেও তদন্ত থামেনি। টুইঙ্কেলের পরিবারের লোকজন জগদীশের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ করেন।
কিন্তু স্থানীয় এক বিজেপি নেতার প্রভাবে পুলিশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যেই মহিলাকে যেখানে খুন করা হয়েছিল, সেখান থেকে টুইঙ্কলের চুড়ি এবং অন্যান্য অলঙ্কারের পোড়া অংশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেগুলির ফরেনসিক পরীক্ষা করেও কোনও সূত্র মেলেনি। উল্টে কুকুরের দেহাংশ উদ্ধারের ঘটনায় কার্যত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন গোয়েন্দারা।
এর পর জগদীশ ও তাঁর এক ছেলেকে গুজরাতের একটি ল্যাবরেটরিতে ‘ব্রেন ইলেক্ট্রিক্যাল অসিলেশন সিগনেচার’ (বিইওএস) টেস্ট করায় পুলিশ। এই পরীক্ষা এক ধরনের ‘নিউরো সাইকোলজিক্যাল’ প্রযুক্তি, যাতে জিজ্ঞাসাবাদে অপরাধী সাধারণত সত্যি কথা বলেন বলেই ধরে নেওয়া হয়। এই কারণেই এই পরীক্ষা পুলিশ মহলে ‘ব্রেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ বলেও পরিচিত।
ডিআইজি মিশ্র বলেন, ‘এই পরীক্ষাতেই কার্যত জগদীশ এবং তাঁর ছেলে খুনের কথা স্বীকার করেন। তারপরই তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি খুনের আগে অভিযুক্তরা এক সঙ্গে দৃশ্যম সিনেমা দেখেছিলেন। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই জগদীশ এবং তাঁর ছেলেরা মিলে মহিলাকে খুন এবং কুকুর মেরে পুঁতে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।’