রাজ্য বোর্ডে পড়ে বা বাংলা মাধ্যমে পড়ে কিছু হয় না। এই ধ্যানধারণা ধীরে ধীরে সাধারণ বাঙালির মনে প্রবেশ করছে। বেসরকারি স্কুল (মূলত সিবিএসই বোর্ড) আস্তে আস্তে শহর ছাড়িয়ে মফঃস্বলকে গ্রাস করছে। এমনকি গ্রামের যে মানুষটার সামর্থ্য আছে তিনিও চেষ্টা করছেন ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে দেওয়ার। এটাই বাস্তবতা। যে স্কুল থেকে এক সময় তারকারা বেরিয়েছে, সেই স্কুলও আজ ছাত্রের অভাবে ভুগছে। এমনকি অনেক স্কুল হিন্দি ও ইংরেজি মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে চায়, ঝাঁ চকচকে স্কুল চায়, এক কথায় উচ্চমানের পরিষেবা চায়।
এখানে অভিভাবকদের দায়ী করা যায় না। সবাই নিজের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। শহরের সরকারি স্কুল গুলো মূলত গরীব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জায়গা হয়ে গেছে। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শ্রেণি বিভাজন স্পষ্ট। এমন একটা সমাজ তৈরি হচ্ছে যেখানে বড় লোক ও গরীব লোকের ছেলেমেয়ে একসাথে পড়বে না, সে সুযোগ হবে না। মফঃস্বলে এ সমস্যা অনেকটা কম এখনও, কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে বেসরকারি সিবিএসই স্কুল। মান যাই হোক, স্কুল বিল্ডিং এর মানই আপাতত মূল মাপকাঠি, মাপকাঠি স্কুলের বেতনও। গ্রামেও এই স্রোত আছড়ে পড়বে, সময়ের অপেক্ষা। সরকারি স্কুল বা বাংলা মাধ্যম স্কুলে শুধু মাত্র গরীব ছেলেমেয়েরাই পড়বে, বাধ্যতাবশত। শ্রেণি বিভাজন ও শ্রেণি বৈষম্য বাড়বে। সরকারি স্কুলে প্রতিযোগিতা কমবে, এটা অবশ্যম্ভাবী।
এবার আসা যাক, উচ্চ শিক্ষার কথায়। ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং র দিকে তাকালে কিছু জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাবে। সিবিএসই বোর্ডের ছেলেমেয়েরা অনৈতিক ভাবে সুযোগ-সুবিধা বেশি পায়। এছাড়া এখন এন্ট্রাস পরীক্ষা গুলো মূলত কোচিং সেন্টার নির্ভর। FitJEE, আকাশ, পথ ফাইন্ডার নামক কোচিং সেন্টার গুলোর দাপট সর্বত্র। এই সব কোচিং এ পড়ার খরচ বছরে কমপক্ষে ১.৫ লাখ। গরীব মানুষের পক্ষে এ ব্যয় বহন অসম্ভব। এখানেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে গরীব ছেলেমেয়েরা। কোচিং সেন্টার গুলোর সাথে এন্ট্রান্স বোর্ড গুলোর সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। মেধা নয়, টাকার কাছে হেরে যাচ্ছে গরীব ছেলেমেয়েরা। পরিশ্রম করে কেউ কেউ সফল হচ্ছে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নয়। একটা গরীব ছেলেমেয়ের সামনে বড় কঠিন লড়াই।
এবার ডাক্তারীতে সমস্যা আরও কয়েকগুন বেশি, জয়েন্ট এন্ট্রান্স নয় মেডিক্যালে ভর্তি হচ্ছে সর্ব ভারতীয় নীটের মাধ্যমে, পরীক্ষা নেয় সিবিএসই বোর্ড। রাজ্য বোর্ড থেকে চান্স পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এক ধাক্কায় তলানীতে। গ্রাম-বাংলায় এখন ডাক্তারি পড়ুয়া দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে। কবছর আগেও এ দৃশ্য ছিল না। অসম প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে মেধা।
শুধু ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং না, অন্যান্য চাকরির পরীক্ষায় সফল হতে এখন বড় বড় কোচিং সেন্টারের দারস্থ হতে হচ্ছে। সেখানেও মোটা অঙ্কের টাকার খেলা। আবার বেশিরভাগ কেন্দ্র সরকারি চাকরির পরীক্ষা বাংলায় হয় না। অর্থাৎ সমাজের একটা অংশের ছেলেমেয়ের কপালে শুধুই দুর্ভোগ। সর্বভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা আবার হিন্দি, ইংরেজির সাথে গুজরাটিতে হচ্ছে। বাঙালিকে এই বঞ্চনা ভাবা যায়?
এভাবে বঞ্চিত হচ্ছে রাজ্য বোর্ডের ছাত্র-ছাত্রীরা তথা গরীব ছেলেমেয়েরা। বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধা সব থেকে বেশি।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা, সঠিক ডোমিসাইল নীতির অভাব। সব রাজ্যে কঠোর ডোমিসাইল নীতি থাকলেও বাংলায় তা নেই। ফলে এখানকার ছেলেমেয়েরা অন্য রাজ্যের সরকারি কলেজে সুযোগ পাচ্ছে না, অথচ এখানকার সরকারি কলেজের আসনে ভিন রাজ্যের পড়ুয়ারা ভাগ বসাচ্ছে। রাজ্যের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলো ভিন রাজ্যের পড়ুয়ায় ভর্তি। সুযোগ কমছে রাজ্যের ছেলেমেয়েদের। মেডিক্যালে ৮৫% রাজ্যের কোটা থাকলেও সেখানেও ডোমিসাইল বি ফর্ম পূরণ করে বাইরের রাজ্যের পড়ুয়ারা ঢুকছে। এ জিনিস অন্য রাজ্যে হয় না।
বোঝা গেল? একটা রাজ্য বোর্ডের ছেলেমেয়ে বা গরীব ছেলেমেয়ে কত রকম ভাবে বঞ্চনার শিকার। চোখের সামনে শুধু অন্ধকার। রাজ্য বোর্ডের জন্য সংরক্ষণ চাই। সঠিক ডোমিসাইল নীতি চাই। নীট বিরোধী আন্দোলন চাই। প্রতিটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব হলে সমস্যা অনেকটাই কমবে।
কিন্তু সমস্যার মূল সমাধান লুকিয়ে আছে একটা জিনিসে, বাংলাকে কাজের ভাষা বানাতে হবে। রাজ্যের সব সরকারি চাকরিতে বাংলা/সাঁওতালি বাধ্যতামূলক করতে হবে। কেন্দ্র সরকারি সব চাকরির পরীক্ষায় বাংলা চাই। রাজ্যের সব প্রশাসনিক কাজ বাংলায় করতে হবে। এই দাবিগুলো পূরণ হলেই গরীব ছেলেমেয়েরা একটু হাসতে পারবে। অর্থাৎ বাংলা শিখতে বাধ্য করতে হবে। রাজ্য বোর্ড তথা বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের অগ্রাধিকার চাই। তাছাড়া কোনো উপায় নেই। সাথে সাথে অবশ্যই রাজ্য বোর্ড ও স্কুলের পরিকাঠামোর সঠিক উন্নয়ন প্রয়োজন।
নাহলে রাজ্য বোর্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। গরীব ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত বলে কিছু থাকবে না। শ্রেণি বৈষম্য আরও তীব্র হবে, ভয়াবহ আকার নেবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )