ছোটবেলায় হনুমান কথাটার সঙ্গে ধর্ম নয়, মজা ছিল। গাছে, পাঁচিলে হনুমান দেখলেই আমরা বলে উঠতাম “অ্যাই হনুমান কলা খাবি?” দুষ্টুমি করলেই বাড়ির বড়দের মুখে তুই একটা আস্ত হনুমান বলে স্নেহমিশ্রিত তিরস্কারটি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। বিশেষ করে একটু বেশি লাফঝাঁপ করা ডানপিটে ছেলেটির তো হনুমান, হনু কথাগুলো আকছার শুনতে হত। ছোট থেকে বড় হয়েও নিস্তার নেই। এই তো সেদিন আমার পুরনো পাড়ার এক বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি আমায় বললেন, এখন দেখছি একটু গম্ভীর হয়েছিস! আগে তো ছিলি একটা আস্ত হনুমান। বৌদি তো বারবার বলতো, ঠাকুরপো, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি ছেলেটাকে একটু শান্ত করে দাও, ওকে একটু সুবুদ্ধি দাও। সেই হনুমানকে ঘিরে এখন দেশজুড়ে কত রকমের অনুমান! মহাকাব্যে বর্ণিত বীর এবং শাস্ত্রজ্ঞ হনুমান এখন স্বাধীন ভারতে এসে পড়েছেন রাজনীতিবিদদের হাতে। একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ হনুমানকে ভাঙিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে চাইছেন।
বালক বয়সের হনুমানের স্মৃতি এই বয়সে এসে এত বিবাদ, বিভ্রান্তি ও আতঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে তা কে জানতো? আমাদের হনুমান ছিল গাছ থেকে গাছে লাফ মারা মুখপোড়া হনুমান। সে মানুষকে মোটেই ভয় পায় না মানুষও তাকে নয়। আর আজ গোটা দেশজুড়ে ধর্মের নামে যে হনুমানকে তৈরি করা হয়েছে তাতে আছে নির্ভেজাল আতঙ্ক আর সন্ত্রাস। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভক্তরা একেকরকম নাম দিয়েছে তার! যিনি কুস্তিগীর তিনি বলছেন কুস্তিগীর হনুমান আবার যিনি ভালবাসেন ক্রিকেট তিনি তার আরাধ্য দেবতাকে ডাকছেন ক্রিকেটার হনুমান নামে। কিষাণ-মজদুরদের কাছে তিনি হয়েছেন কিষাণ-মজদুর হনুমান। এই যুক্তি মেনেই আমাদের এই পোড়া দেশে এখন জাঠ হনুমান, জৈন হনুমানরাও বিরাজ করছেন। মজার ব্যাপার হল হনুমানের মালিকানা নিয়ে এখন বেজায় গোল বেঁধেছে। এতরকমের হনুমানকে নিয়ে এখন তাদের স্রষ্টারাও ব্যপক ধন্ধে পড়ে গেছেন। গোল মেটাতে অবশেষে তারাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ভগবানের কোন জাত নেই।
রাজনীতিবিদরা যে হনুমান ও হনুমানভক্তদের নির্মাণ করেছেন তা ধর্মের হনুমানের সঙ্গে মেলে না। মহাকাব্য বা শাস্ত্রে এমন হনুমানভক্তদের আমরা দেখিনি। কলা নয়, আজকের দিনে হনুমানভক্তদের হাতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র, ভক্তির বাণী নয়, মুখে থাকে বিভেদের বিষ। চোখের সামনে দেখছি ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতি দেশজুড়ে একটা মিথ- এর পুননির্মাণ করছে। দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বাতাবরণ তৈরি করার জন্য হনুমানকে ব্যবহার করছেন তারা। ধর্ম নিয়ে খেলার সবচেয়ে বড় বিপদ হল তা যুক্তিহীন বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে এবং যারা এটা তৈরি করেন অবশেষে তারাই এতে বিপন্ন হন।
ছোটবেলায় পাড়ার মেলার গেটের সামনে একটা পেল্লায় হনুমানের মূর্তি দেখতাম। সে মাঝেমধ্যেই বুকটা নখ দিয়ে চিরতে চিরতে বলে উঠতো জয় রাম। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতাম তার বুকের ভিতর ফিট করা রাম-সীতার ছবি। মূর্তির চারপাশ ঘিরে থাকতো ঊর্ধ্বমুখী মানুষের ভিড়। তাতে বিস্ময় থাকতো, যেন বেশ একটা মজার জিনিস হচ্ছে কিন্তু তেমন কোন বিশ্বাস থাকতো বলে মনে হয়নি। কিন্তু রামধ্বনি দেওয়া হনুমান সেনাদের দিকে তাকালে মানুষ আতঙ্কিত হন। অভয়বাণী দেওয়া পবননন্দনকে রাজনৈতিক হনুমানদের সঙ্গে তারা মেলাতে পারেন না। মহাকাব্যের হনুমান কোন প্রচার ও প্রতিশ্রুতি ছাড়াই মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারতেন কিন্তু এই হনুমানভক্তদের তাদের স্রষ্টারাও এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
কথা হচ্ছিল বাংলার এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে। হিন্দু শাস্ত্র ও মহাকাব্যগুলির বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি নিজেই বেশ বিরক্ত। বললেন, হনুমান একটা বিশেষ প্রজাতির বানর। আমাদের মহাকাব্য ও শাস্ত্রে নানা প্রসঙ্গে তিনি এসেছেন। কিন্তু ধর্মের ধ্বজাধারী বিভেদপন্থীরা হিন্দুধর্ম ব্যাপারটা এখন নিজেদের মত করে অপব্যাখ্যা করছেন। এর সঙ্গে হনুমান, হিন্দুধর্ম কোনকিছুরই সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে শুধু রাজনীতির। ওরা নিজেদের মত করে একটা মনগড়া ইতিহাস তৈরি করছেন। রাজনীতির লোকেদের হাতে ধর্ম পড়লে তাকে নিয়ে তো রাজনীতিই হবে। আমার একটা জিনিসই খুব খারাপ লাগে তা হল, আমাদের আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসব দেখে কী শিখছে? এটা খুব বিপজ্জনক ব্যাপার।
তার কথার সূত্রেই আমার মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা এই কবিতাটিতে যুদ্ধবাজ মানবতাবিরোধী শক্তিগুলি ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করে তা নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল সেই কবিতার দুটি লাইন � তাই ওরা চলে দলে দলে/ বুদ্ধেরে নিয়ে নিজ দলে। নিজেদের কুকর্মের সমর্থনে যুদ্ধবাজরা অহিংসার পূজারী বুদ্ধদেবের নামটাকেও কীভাবে ব্যবহার করছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখন ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটছে। অশান্তির পূজারীদের মুখেই এখন আমাদের শুনতে হচ্ছে ধর্মের কথা, শান্তির কথা। দেশকে গড়ার আওয়াজ তুলে ধর্মের ভিত্তিতে তা ভাগ করার চক্রান্ত করছেন একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ।
হনুমান নিয়ে মনের মধ্যে জমে থাকা এতসব প্রশ্ন নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম গঙ্গাসাগর। আজ সন্ধ্যার সময় একটু নিরিবিলিতে কপিল মুনির আশ্রমের মোহান্ত জ্ঞানদাসের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি পরিষ্কার বললেন, �হনুমানের নাম করে যা বলা হচ্ছে তা মোটেই ঠিক নয়। উনি ভগবান, আর ভগবান কখনোই কোন বিশেষ মানুষ বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়, উনি তো সবার। ভোটের রাজনীতির জন্যই কিছু মানুষ এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। ভগবানকে নিয়ে ওরা তো কোর্টেও গিয়েছে। তাতে কি কিছু সমাধান হল? আসলে কাজ করতে হবে, মানুষের জন্য কাজ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিয়ে তিনি বললেন, য্যয়সে ইয়ে লড়কি কিয়া… । ইনি যদি দেশের হাল ধরেন তাহলে গঙ্গাসাগরের মত দেশটাও বদলে যাবে। ২০১১র পর থেকে গোটা গঙ্গাসাগরের চেহারা বদলে দিয়েছেন ইনি। আগের গঙ্গাসাগরের সঙ্গে এ গঙ্গাসাগরের আসমান জমিন ফারাক। সত্যি গোটা গঙ্গাসাগরের চেহারা যে বদলে গিয়েছে তা এখন এখানে পা রাখলেই বোঝা যায়। একথা শুধু আমি বলছি না সারা ভারত থেকে গঙ্গাসাগরে আসা তীর্থযাত্রীরাও বলছেন। আমিও তো পুরনো গঙ্গাসাগরের সঙ্গে এ গঙ্গাসাগরকে মেলাতে পারি না।
মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এই গঙ্গাসাগরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু, সন্ন্যাসী ও ধর্মভীরু মানুষরা আসবেন। এরা আসবেন তাদের বিশ্বাস নিয়ে, মনস্কামনা পূরণের আশা নিয়ে। এদের অনেকেই প্রকৃত হনুমানভক্ত। সে বিশ্বাসকে তারা লালন করেন নিজেদের বুকের ভিতর। নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অস্ত্র হাতে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন না তারা। এই হল ভারতবর্ষ, আমার দেশ। এই বিশ্বাসের ভূমিতে হনুমানের নাম করে নিজেদের মনগড়া নানা অনুমান খাড়া করে বিভেদের রাজনীতির কোন জায়গা নেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)