তাঁর মাথাজোড়া টাক দেখেছেন সবাই। কিন্তু পাসপোর্ট দেখেননি কেউ। তিনি ডিওয়াইএফআই-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক অভয় মুখার্জি।
একাধিকবার বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে অভয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ায় হোলটাইমার ওয়েজ তোলার পাশাপাশি শিক্ষকতার বেতনও নিজের ট্যাঁকে ভরেন অভয় মুখার্জি। তাঁদের প্রশ্ন, একইসঙ্গে হোলটাইমার ওয়েজ এবং শিক্ষকতার বেতন তিনি নেন কীভাবে? এমন কান্ড যেমন দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী তেমনই নৈতিকতা বিরুদ্ধও। কিন্তু অভয়বাবু অবিচল। কোনও বিতর্ক-অভিযোগই তাঁর গায়ে লাগে না।
বিতর্কের সূত্রপাত ডিওয়াইএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সময় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে। দলের গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী ৪০ বছর বয়সের পর ডিওয়াইএফআই করা যায় না। অভিযোগ, অভয় দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন মধ্য চল্লিশে। তখনই চুলহীন মাথাজোড়া টাকের অধিকারী অভয়কে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি কী করে দলের সম্পাদক নির্বাচিত হলেন? এই ব্যাপারে একটি সংবাদমাধ্যমে সাফাই দিয়ে অভয় বলেছিলেন, ‘ঘোরাঘুরি করে বিভিন্ন রাজ্যের জল খেয়ে চুল উঠে গেছে’। কিন্তু সিপিএমের অন্দরের গুঞ্জন, দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রিয়পাত্র হওয়ার সুবাদেই এসব সুযোগসুবিধা ভোগ করেন ‘বহু ঘাটের জল খাওয়া’ অভয়।
২০১২ সালের পর ডিঅয়াইএফআই-এর সর্বভারতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে। প্রতি তিন বছর অন্তর। কিন্তু অভয় সেটাকে টেনে নিয়ে যান ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। এবং সেবারও সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনিই। তখন অভয় পঞ্চাশের দোরগোড়ায়। এবং এখনও তিনি যুবক। অন্তত তাঁর দাবি সেটাই। এছাড়াও একাধিক বিশ্বছাত্র যুব উৎসবের সময় অনেকেই তাঁকে পাসপোর্ট দেখাতে জোরাজুড়ি করেছিলেন। কারণ, পাসপোর্টে বয়সের উল্লেখ থাকে। সেটা সামনে এলেই দুধ-জল আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু সুকৌশলে তা এড়িয়ে যান অভয়।
অভিযোগের তালিকা এখানেই শেষ নয়। সর্বভারতীয়স্তরে গণসংগঠনের নেতৃত্বকে সর্বক্ষণের কর্মী হওয়াটাই সিপিএমের দস্তুর। অভিযোগ, এখানেও সূর্যকান্ত মিশ্রের সহযোগিতায় অভয় সুকৌশলী। কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদীও। বাঁকুড়া জেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন অভয়। দল থেকে তাঁকে স্কুল ছাড়তে বলা হয়। অভয়, পার্টিকে জানান, শিক্ষকতা ছেড়ে এখন তিনি শুধু পার্টিরই সর্বক্ষণের কর্মী। এবং হোলটাইমার ওয়েজও তুলতে থাকেন তিনি। কিন্তু পরে জানা যায়, দলের হোলটাইমার ওয়েজ তোলার পাশাপাশি এক প্রভাবশালী মহিলা পদাধিকারীর সঙ্গে যোগসাজশে নিয়মিত শিক্ষকতার বেতনও তুলে যাচ্ছেন অভয়।
চলতি বছরে দিব্যি রাজ্য কমিটির মেম্বারও হন সূর্য মিশ্রের প্রিয় পাত্র ‘স্কুলশিক্ষক’ ও ‘হোলটাইমার’ অভয়। কিন্তু গোল বাঁধে তারপর। বাঁকুড়া জেলা সিপিএমের একদল কর্মী অভয়ের বেতন তোলার বিষয়ের যাবতীয় কাগজ-সহ প্রমাণপত্র জমা করেন দলে। হইচই বেঁধে যায়। জানা যায়, দলের সর্বক্ষনের কর্মী অভয় ২০১৮ সালের জুলাই অবধি বেতন তুলে গেছেন নিয়মিত। অর্থাৎ ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত টানা ৬ বছর দলকেমিথ্যা বলে গেছেন যে, চাকরি ছেড়েছেন। আসলে অভয়ের উদ্দেশ্য ছিল ২০১৯ এর মার্চ মাসে চাকরির ২০ বছর পূর্ণ করে পুরো পেনশন উপভোগ করা। এদিকে দলে কাগজপত্র জমা পড়তেই অভয় আগস্ট মাসে স্বেচ্ছাবসরের আবেদন করেন। কিন্তু এরপরেও সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে অভয়ের বয়স ভাঁড়ানো থেকে হোলটাইমার হয়েও স্কুলের বেতন তোলার বিষয় নিয়ে হইচই হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য কমিটির বৈঠকে গোটা বিষয়টি সুকৌশলে ধামাচাপা দেন সুর্য মিশ্র।
ঠিক যেভাবে কৌস্তভ-সৌম্যজিত-রজকের যাবতীয় দোষ জানা স্বত্বেও ধামাচাপা দিয়ে গেছেন সূর্য মিশ্র, অভয়ের ক্ষেত্রেও তাই করেছেন দলের রাজ্য সম্পাদক। শেষে কৌস্তভের যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর দলীয় কর্মীদের চাপাচাপিতে ৩ মাসের লোকদেখানো শাস্তি দিতে বাধ্য হন তিনি। দলীয় কর্মীদের একাংশের মতে, জানাজানি হয়ে যাওয়ায় অভয়ের ক্ষেত্রেও লোক দেখানো শাস্তি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন সুর্যকান্ত। এখন দেখার অভয় মুখার্জির লোকদেখানো ‘জরিমানা’ হয় না অন্য কিছু।
