এ’বছর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলা ভাষার অন্যতম শক্তিশালী কিন্তু আত্মপ্রচার বিমুখ কবি প্রসূন ভৌমিক। ‘একটি আগ্নেয়গিরির তথ্যচিত্র’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০ তম বর্ষে “জন্মদিন” পত্রিকা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নামাঙ্কিত এই পুরস্কারটি তুলে দিচ্ছে কবি প্রসূনের হাতে।
নব্বই দশকে মধ্যরাতের কলকাতা শাসন করত যে-যুবদল, তার মধ্যমণি ছিলেন প্রসূন। ১৯৯০ সালে তিনি অঙ্কুর মিশ্র, অর্চিতা গোস্বামী, সৌভিক মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন “বিজল্প” পত্রিকা। পরবর্তীতে তাঁর বন্ধু কবি সাম্যব্রত জোয়ারদার, কবি ও সঙ্গীতকার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি মউলি মিশ্র, প্রয়াত কবি তাপস কুমার লায়েক, কবি অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক নুরুল মোস্তফা, অধ্যাপক প্রিয়দর্শিনী সেনগুপ্ত, শিক্ষক সৈয়দ তৌফিকুল্লাহ, শুভময় সরকার, কুণাল মিত্র সহ বাংলার নানা প্রান্তের কবিতা প্রয়াসীদের বন্ধুতার মেলবন্ধনে “বিজল্প” নব্বই দশকের প্রধান সাংস্কৃতিক সংগঠন হয়ে ওঠে। শুরু হয় নতুন কাগজ “বিজল্প ১৫ দিনে”। নব্বই দশকে কবিতা চর্চার প্রধান প্ল্যাটফর্ম। শুরু হয় “বিজল্প” প্রকাশনাও।
গিটারে সুপ্রতিম ভৌমিক, খোলবাদ্যে প্রসূন সহ বিজল্পের সমবেত বৃন্দগান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী সিঁড়ি থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, স্কটিসচার্চ, বঙ্গবাসী কলেজ ছাড়িয়ে সোদপুর, মুর্শিদাবাদেও প্রভূত সমাদর পায়। এক অর্থে বিজল্পই নব্বইয়ের প্রথম অঘোষিত বাংলা ব্যান্ড। যার ঠিকানা ছিল শিয়ালদহর বঙ্গবাসী কলেজের ঠিক পাশেই স্কট লেনে, খোদ প্রসূনের বাড়িতে। ওই সময়কার নবীন কবি, সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের আনাগোনা লেগেই থাকত প্রসূনের ঘরে।
সেই সময়েই তিনি সংস্পর্শে আসেন কবি জয় গোস্বামী, সঙ্গীতকার কবীর সুমন, গণগায়েন প্রতুল মুখোপাধ্যায়, শিল্পী শুভাপ্রসন্নর মতো বহু গুণীজনের। তাঁদের থেকে প্রশ্রয় এবং অনুপ্রেরণা পেয়ে আরও সমৃদ্ধ হয় তাঁর কলম। তারই ফলস্বরূপ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো বাংলা ভাষার এক বরেণ্য কবির নামাঙ্কিত পুরষ্কারের প্রাপক তালিকায় তাঁর নামও জুড়ল।
কবি প্রসূন ভৌমিকের জন্ম ১৯৬৯ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁর বাবা ডা. প্রণব কুমার ভৌমিক অধ্যাপক ও প্রথিতযশা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মা গীতাঞ্জলি ভৌমিক। ১৯৮৬ সালে হিন্দু স্কুল থেকে পাশ করে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন বঙ্গবাসী কলেজে। সেখান থেকে নৃতত্ববিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর মানপত্র লাভ করেন তিনি।
কবিতা লেখার শুরু ১৯৮৯-৯০ সালে। তারপর থেকে থামেনি তাঁর কলম। কবির লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘একটি আগ্নেয়গিরির তথ্যচিত্র’ (১৯৯৬), ‘পাখিদ্বীপ জাদুঅলা বন্ধুপদাবলী’ (সাম্যব্রত জোয়ারদার ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা, ১৯৯৭), কবিকন্যাকে নিয়ে লেখা ‘বুয়া ও বাবুই’ (২০০৬), ‘মাটির মানুষ’ (২০০৮), ‘ভদ্দরলোক’ (২০০৯), ‘দ্রিমি দ্রিমি হুল’ (গদ্য-পদ্য, ২০১১), ‘হিন্দু স্কুল’ (২০১৬), ও ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা বান্ধবী’ (২০১৭)। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রন্থতিনটি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় পরিপ্রেক্ষিতে রচিত।
তবে কেবল লেখকের ভূমিকায় নয়, বাংলা সাহিত্য তাঁকে পেয়েছে প্রকাশকের ভূমিকাতেও। নব্বই দশকের বহু নবীন (বর্তমানে বিখ্যাত) কবিদের প্রথম/দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ছাড়াও বিজল্পের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনায় রয়েছে মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, কবীর সুমন, বিভাস চক্রবর্তী, পিনাকী ঠাকুর, সুকুমার মিত্র, সুজাত ভদ্রের মতো বাংলার প্রথম সারির কবি, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীদের রচনা। এর মধ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় পর্বে জয় গোস্বামীর লেখা ‘শাসকের প্রতি’ ও ‘হার্মাদ শিবির’ বইদুটি এবং কবীর সুমনের ‘ছত্রধরের গান’ নামক সিডি প্রকাশনা করে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা প্রমাণ দেয় তাঁর ঋজু শিরদাঁড়ার।
পুরষ্কার পাওয়ার পর কবি বলেন, ‘কবিতা আমি নিজের জন্য লিখি… কিন্তু সেই কবিতার সঙ্কলন যখন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো একজন শক্তিশালী কবির নামাঙ্কিত পুরষ্কার পায় তখন ভালো লাগে। মুর্শিদাবাদের “জন্মদিন” পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরেই সাহিত্যচর্চা করে আসছে। তাদের থেকে পুরস্কার পাচ্ছি এটা ভেবে ভালো লাগছে। যে কোনও লিটিল ম্যাগাজিনের থেকে পুরস্কার পেতেই ভালো লাগে। আমার মনে হচ্ছে গোটা নব্বই দশকই যেন আমার সঙ্গে এই পুরস্কার পাচ্ছে। এই পুরস্কার ও সম্মান আমি আমার দশকের এবং আমার পরের প্রজন্মের যত কবি আছেন, তাঁদের উৎসর্গ করছি।’
প্রিয় অনুজ ছাত্র প্রসূন সম্পর্কে বলতে গিয়ে হিন্দু স্কুলের অগ্রজ কৃতি প্রাক্তনী ও বর্তমানে শহরের প্রখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডা. শুভেন্দু বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “কবির কবিতা হলো একটি মালা! প্রতিটি শব্দই এক একটি ফুল, যা বড় যত্নে চয়ন করেন কবি। মালা গেঁথে তৈরি করেন এক একটি কবিতা। বড় শক্ত এই কবিতা লেখা, বড় শক্ত তাকে মনোগ্রাহ্য এবং মনোরঞ্জিত করে তোলা। শক্তি এক সময় বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। অর্থাৎ লেখেন অনেকেই। কিন্তু সেই লেখা কবিতা হয়ে ওঠে অনেক শক্ত পরীক্ষা পাস করে। পাঠকের হাজারদুয়ারি মনের তালা খুলতে পারলে তবেই কবিতা। প্রসূনের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়।”