এবার হিন্দুত্ববাদীদের কোপের মুখে পড়া নাসিরুদ্দিন শাহের পাশে দাঁড়ালেন বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। এই বর্ষীয়ান অভিনেতার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বিক্ষোভের তীব্র নিন্দা করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টরা।
নাসিরুদ্দিনের সমর্থনে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমায় স্বমহিমায় বিরাজমান এই বর্ষীয়ান শিল্পীকে আজ হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে যেভাবে অপমান ও হেনস্থা করা হচ্ছে, তা আমাদের দেশের সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কাছেই অত্যন্ত অপমানজনক এবং লজ্জার। ধর্মীয় ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং সমাজজীবনে সুস্থতা ও প্রগতির স্বার্থে নাসিরুদ্দিনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ বারবার দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।’
এর পাশাপাশি, বিজেপি-সহ ওই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির বিরোধীতা করে বলা হয়, ‘দেশটাকে সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গার আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় এরা। যাঁরা নাসিরুদ্দিন শাহর এক ব্যক্তিত্বকে এমন কুৎসিত ভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করছে, তাদের লক্ষ্য ধর্মের নামে ভাগাভাগির রাজনীতি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করা।’
প্রসঙ্গত, ডিসেম্বরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরে গো-হত্যাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ছড়ালে এক পুলিশ অফিসার নিহত হন। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে কীভাবে গো-হত্যা হলো সেই তদন্তের ওপরে। আর পুলিশ অফিসারের মৃত্যুকে তিনি বলেছিলেন ‘দুর্ঘটনা’।
সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ নাসিরুদ্দিনের মন্তব্য, ‘এমন পরিস্থিতি দেখে আমার ভয় নয়, রাগ হচ্ছে।’ সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আয়োজিত ‘কারওয়ান-এ-মুহব্বত’ নামের এক অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে তিনি একটি ভিডিও সাক্ষাতকার দেন। সেখানে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘বিষ সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে, তারা অবাধে ঘুরছে। আমরা সম্প্রতি দেখেছি, একটি পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর চেয়ে একটি গরুর মৃত্যু বেশী গুরুত্বপূর্ণ।’
এর পরেই নাসিরুদ্দিনের সমালোচনায় গর্জে ওঠেন দেশের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। গত শুক্রবারে তাঁর নিজের স্কুল আজমেরে সেন্ট আনসেলম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে এক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল নাসিরুদ্দিনের। কিন্তু সেখানেও তাঁর তীব্র বিরোধিতা করে স্লোগান দিতে শুরু করে বিজেপির যুব জন মোর্চা ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। পোড়ানো হয় তাঁর কুশপুত্তলিকাও। যার ফলে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় উৎসবের মঞ্চে ভাষণ না দিয়েই আজমির ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন ৬৮ বছর বয়সী অভিনেতা।
তবে এখানেই শেষ নয়। নাসিরুদ্দিনকে অপমান করার উদ্দেশ্যে নবনির্মাণ সেনার সভাপতি অমিত জানি তাঁর জন্য পাকিস্তানের একটি ওয়ান ওয়ে টিকিট কেটে সে খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। আবার উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা মহেন্দ্রনাথ পান্ডে বলেন, ১৯৯৯ সালে ‘সরফরোশ’ নামে এক ছবিতে নাসিরুদ্দিন পাকিস্তানি এজেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মনে হয়, তিনি সত্যি সেই ধরনের চরিত্রে পরিণত হচ্ছেন।
এভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপের মুখে পড়ে বর্ষীয়ান অভিনেতার অনুষ্ঠান বাতিল করার বিরুদ্ধেই সোচ্চার বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। সদ্য প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে সই করেছেন আরও দুই প্রবীণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, নাট্য সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি মন্দাক্রান্তা সেন, চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকর্মী কৌশিক সেন, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, অরুণ মুখোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।