চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই-এর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বাংলা বাজারে একদল সমালোচক ব্যক্তিগত আলোচনা, ফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মুন্ডপাত করতে শুরু করেছেন। এই সামান্য লেখায় তাদের বক্তব্য খণ্ডন করার মত দুঃসাহস আমার নেই। ধৃত সাংবাদিকের সমর্থনে আমি কিছু বলছি না, বলার দরকারও নেই, কারণ আমি বিশ্বাস করি আইন আইনের পথেই চলবে। আমি শুধু কিছু সাধারণ তথ্য তাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমার প্রশ্ন পুলিশ, ইডি কিংবা সিবিআই কাউকে গ্রেপ্তার করলেই বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠালেই কী তিনি অপরাধী হয়ে যান? এটা তো তাকে যারা গ্রেপ্তার করেছেন তারাও বলেন না! ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও এমন কোন কথা বলা নেই! তাহলে ফোনে, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে গত দুদিন ধরে কাকেদের কা কা ধ্বনির মত এত সুমন-সুমন রবে থেকে থেকে চমকে উঠতে হচ্ছে কেন? গত পরশুদিন সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় মনিপুরের এক সাংবাদিককে আটক আইনে জেলে পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম। সেখানেও দেখলাম অন্তত জনা চারেক মানুষ বিষয়বহির্ভূতভাবে সুমনদার প্রসঙ্গ টেনেছেন। বিচারের আগেই অপরাধী হয়ে গেলেন বাংলা সংবাদপত্র জগতের এই সময়ের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়।
আমি দীর্ঘদিন সুমনদার সঙ্গে কাজ করেছি, আজকালে এবং আনন্দবাজারে। পরিকল্পনা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, লেখা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, সাহস এবং একটা সিদ্ধান্ত নিলে পিছু না হটে সেটা নিয়ে লড়ে যাওয়ার জেদ এতসব গুণের সমন্বয় আমি দেখেছি তার মধ্যে। তাই আমি আমার সমসাময়িক সব সতীর্থদের থেকে তাকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রাখবো। এতে কারও দীর্ঘশ্বাস পড়তে পারে, কেউ রেগে যেতে পারেন। আমি জানি, আমার অনেক ঘনিষ্ট বন্ধু একথা মানবেন না কিন্তু এটা আমার বিশ্বাস। সুমনদা কোন চিটফান্ড থেকে কত টাকা নিয়েছেন বা নেননি সেটা তো তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু সেই বিচার শেষ করার আগেই ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ বা অপ্রাপ্তি থেকে কাউকে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া যায়? দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটছে। আর তার বিরুদ্ধে নিন্দায় মেতেছেন তারই সহায়তায় বাংলা কাগজে যারা আজ করেকম্মে খাচ্ছেন তেমন কয়েকজন।
চিটফান্ডের যেকোন রকমের কাজকারবারের আমি বিরোধী। চোখের সামনে দেখেছি এদের টাকা বানানোর খেলায় মানুষ কীভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে সুমনদা যদি এদের মদত দিয়ে থাকেন তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার হোক। আইন মেনেই তার শাস্তি কিংবা মুক্তি আমাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু বিচারের আগেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছি কেন? আজ যারা অফিসের করিডরে কিংবা ক্লাবে তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন তাদের অনেকেই কিন্তু নানা সময়ে তার কাছ থেকে নানা উপকার পেয়েছেন। কারও হয়েছে চাকরি, কেউ পেয়েছেন প্রোমোশন এমনকি বাড়িভাড়া কিংবা বউয়ের চাকরির জন্য তাদের অনেককেই আমি সুমনদার ঘনিষ্ট হতে বা তার কাছে তদ্বির করতে দেখেছি। সরকার বাড়ি থেকে অন্য কাগজে� চলে যাওয়া এক সাংবাদিককে দেখেছি আবার সেই বাড়িতে ফেরার জন্য সুমনদার কাছে তদ্বির করতে। সরকার বাড়ির আশেপাশে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। আজ সুমনদার বিপদে দেখছি তিনি সবার আগে পথের কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছেন। গায়ে পড়ে আলোচনা শুরু করে তিনি আমায় বললেন, �যা হয়েছে না দেড় দু-বছর ভেতরে থাকতে হবে।� কেউবা বলছেন, এত লোভ, কেরিয়ারের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেও ওর এত টাকার দরকার হল কেন? বিষয়টাকে আরও আঁশটে করে তুলতে এরমধ্যে নারীচরিত্রেরও আমদানি হচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে দেখছি কর্মজীবনে যারা তার সাফল্যের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি তারাই রয়েছেন এই হাল্লা ব্রিগেডের সামনের সারিতে।
চিটফান্ড কান্ডের তদন্তের একেবারে গোড়ার দিকে ধরা পড়া এক সাংসদ-সাংবাদিক সুমনদার গ্রেপ্তারের পর সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন তিনি ধরা পড়ার পর মিডিয়া সরব হয়েছিল কিন্তু সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারিতে তারা নীরব কেন? তা কি উনি বড় কাগজের সাংবাদিক বা তার নাম ডাক বেশি বলে? সুমনদাকে অভিযোগকারী নিজের সমগোত্রীয় বলে ভাবতেই পারেন, এটা তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, কিন্তু আমি জানি, সুমনদার এত দুঃসময়েও তার কঠোর সমালোচকরাও সেই সাংবাদিক ও সুমন চট্টোপাধ্যায়কে একাসনে বসাবেন না বা তুলনামূলক বিচারের দাড়িপাল্লায় চড়াবেন না।
আমি জানি এ লেখাটা পড়তে পড়তেই অনেকেই আমাকে সুমনদার চামচা বা দালালের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই কিন্তু আজকে যারা তার নিন্দা করছেন তাদের অনেকেই তার কাছ থেকে ব্যক্তিগত অনুগ্রহ নিলেও আমার বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগ আনা যাবে না। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করি আমি, স্ত্রী চাকরি করেন। দুজনের রোজগারে আমাদের মোটামুটি চলে যায়। মালিকদের মর্জিমাফিক চলতে পারিনি বলে সরকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুমন চট্টোপাধ্যায় কেন কাউকেই আমার তেল দেওয়ার দরকার নেই। সুমনদার সঙ্গে বহু ব্যাপারেই আমার মতের অমিল রয়েছে। আমার মনে হয় আত্মম্ভরিতা এবং তোষামোদ পছন্দ করা তার একটা বড় দুর্বলতা। কিন্তু তা বলে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে তাকে অপরাধী বলতে পারবো না। বরং তার এই দুঃসময়েও মনে রাখার চেষ্টা করবো, এই মানুষটার কাছে আমি কাজ শিখেছি; একসঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট করেছি; বিপজ্জনক দুর্গম জায়গায় কাজ করার সময় যিনি সবসময় আমার খোঁজখবর নিয়েছেন সেই সুমনদাকেই আমি মনে রাখবো। সুমনদার স্ত্রী কস্তূরী, মেয়ে টুপুর এবং ছেলে রিওকে এই মিডিয়া ট্রায়াল যে সামাজিক অপমানের মুখে দাঁড় করিয়েছে তার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। প্রায় বছরখানেক হল মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া সুমনদার সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু কোন বন্ধু বা দাদা যাকে ভালবাসি সে বিপদে পড়লে তাকে ফেলে পালানোর লোক আমি নই। আমি এখনও সুমনদার পাশেই আছি ও থাকবো। কারণ আমি হিপোক্র্যাট নই।
আমি বিচারের আগেই তাকে অপরাধী সাজানোর এই প্রবণতার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সুযোগসন্ধানী নিন্দুকদের বলছি এ বড় বিপজ্জনক খেলা, এটা অবশেষে যারা এটা শুরু করেন তাদেরই স্পর্শ করে। সিবিআই যাদের ধরে বা জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা সবাই যদি অপরাধী হয় তাহলে গোটা দেশটাই তো জেলখানা হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে রাজনৈতিক দলগুলির অফিস। ভোটে দাঁড়ানোর লোক পাওয়া যাবে না। আমরা দেখেছি সিবিআই গ্রেপ্তার করার পরেও বিচারে বহু মানুষ কলঙ্কমুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। বিচারের আগে কাউকে দোষী বলে দেওয়াটাই তো একটা অপরাধ।
আমার একটাই অনুরোধ তড়িঘড়ি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভাবুন। ভুল বুঝে বা ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে পরে কিন্তু নিজেরই খারাপ লাগবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )