খবরের কাগজে মণিপুরের সাংবাদিক কিশোরচন্দ্র ওয়াংখেমের জাতীয় নিরাপত্তা আইনে জেলে যাওয়ার খবরটা পড়ে আমার মনোজ মিত্রের বিখ্যাত নাটক নরক গুলজারের এই গানটা মনে পড়ে গেল। একসময় বাংলা নাটকের দর্শকদের মুখে মুখে ঘোরা এই গানের পরের লাইনটা ছিল – ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন গোলযোগ সইতে পারেন না। সত্যি দেশের শাসকরা যেন শীতঘুমে গিয়েছেন, তারা কোন গোলযোগ, প্রতিবাদ, সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। মণিপুরের স্থানীয় কেবল টিভির সাংবাদিক কিশোরচন্দ্রের অপরাধ তিনি ফেসবুকে একটি ভিডিও পোষ্টে �মোদী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং-এর সমালোচনা করেছিলেন। একারণে প্রায় একমাস আগে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে একবছর জেল হয়েছে তার।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশই অসহিষ্ণু। কোন সমালোচনা, প্রতিবাদ শোনার অভ্যাস তাদের নেই। কেন্দ্র বা রাজ্যের বহু সরকারের আমলে শাসকদের এই স্বৈরাচারী প্রবণতা দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এরফলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তারা, সরে গেছে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক, অবশেষে নির্বাচনে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। তবুও এই প্রবণতা শাসকদের ছাড়েনি। মনে হয় পুজো-আচ্চার এই দেশে একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ নিজেদের দেবতা ভাবতে শুরু করেন। কাঁচাখেগো দেবতাদের মত অল্পতেই কুপিত হন তারা। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হতে থাকে কিশোরচন্দ্রকে জেলে পোরার মত ক্ষমতা প্রদর্শনের নানা উদাহরণ।
ফেসবুকের পোষ্টে অভিযুক্ত সাংবাদিক সরকারি প্রচারের বিরুদ্ধে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন একটি সত্যকে। তিনি বলেছিলেন, মণিপুরের সঙ্গে ঝাঁসির রানি লক্ষীবাইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা সবাই জানি এটা একটা সাধারণ সত্য। বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে লক্ষীবাইয়ের লড়াইয়ের কথা আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশাত্মবোধের শিক্ষা, প্রতিবাদের সাহস যুগিয়েছিলেন তিনি। লক্ষীবাই বলতে আমাদের মনে পরে তাঁর সেই বিখ্যাত ঘোষণা � ম্যয় মেরি ঝাঁসি নহি দুঙ্গি। কিন্তু মণিপুরের সঙ্গে এই বীরাঙ্গনার সম্পর্ক আবিষ্কার করাটা নেহাতই এক কষ্টকল্পনা। মণিকর্ণিকা থুড়ি লক্ষীবাইয়ের সঙ্গে মণিপুরের কোন সম্পর্ক নেই। এই সত্যি কথাটা বলার অপরাধে কাউকে কারাবাস করতে হবে কেন?�
গোবলয়ের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দেশের মহাপুরুষ, বীর, বীরাঙ্গনাদের ব্যবহার করার যে খেলায় মেতেছে এটি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গোটা দেশের ওপর নিজেদের রাজনীতির মাপসই একটা ইতিহাস চাপিয়ে দিতে চাইছেন তারা। এরা দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার একটা চতুর খেলা শুরু করেছেন। আমার প্রশ্ন, তা মানার দায় একটা যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের থাকবে কেন? এমনিতেই গোটা উত্তরপূর্ব ভারত জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ বেশ শক্তিশালী। এদের অনেকেই তীব্র ভারতবিরোধী। ভুল ও অযৌক্তিক ইতিহাস তো বিচ্ছিনতাবাদকেই শক্তিশালী করবে।
গত ২১শে নভেম্বর পুলিশ কিশোরচন্দ্রকে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল। এই অভিযোগ খারিজ করে ২৫শে নভেম্বর তাকে জামিনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরে আবার আরেকটি নির্দেশে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে একবছর জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হল। সরকারের যুক্তি জেলের বাইরে থাকলে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কাজকর্মে যুক্ত থাকবেন। এর আগে বিজেপিকে বুধু জোকার পার্টি বলে ফেসবুকে একটি পোষ্ট দিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
প্রতিবাদ যেন মণিপুরের একটা অভ্যাস। এই রাজ্যের স্বাধীনচেতা ও প্রতিবাদী মানুষ বারবার প্রতিবাদের নানা দৃষ্টান্ত তৈরি করে চলেছেন। সামরিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মনিপুরের নারীদের নগ্ন প্রতিবাদ ভারত তো বটেই গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কোনভাবেই তাদের দমানো যায়নি। এবারও কিশোরচন্দ্রের সমর্থনে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন তার সতীর্থ সাংবাদিকরা। প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়েছে গোটা দেশে। সাউথ এশিয়া মিডিয়া ডিফেন্ডারস নেটওয়ার্ক বা সামডেন-এর পক্ষে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অবিলম্বে কিশোরচন্দ্রের মুক্তি এবং তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। এই বিবৃতিতে সই করেছেন সঞ্জয় হাজারিকা, রাজদীপ সারদেশাই, নিধি রাজদান, দিলীপ চেরিয়েন, সঙ্গীতা বড়ুয়ার মত সংবাদ ব্যক্তিত্বরা। প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট ইউনিয়ন ও প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াও।���
তবে আমি অবাক হলাম কলকাতার সাংবাদিকদের দেখে। প্রতিবাদনগরী কলকাতার সাংবাদিকরা এব্যাপারে নীরব। অথচ একসময় এ শহরই ছিল শাসকদের কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামনের সারিতে। দেশ বা বিদেশ যেখানে মানুষের বিরুদ্ধে কোন অন্যায় হয়েছে তখনই প্রতিবাদমুখর হয়েছে এই শহর। হয়তো বছর শেষে আমার সাংবাদিক বন্ধুরা বর্ষশেষের নানা আমোদপ্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। কিন্তু অপছন্দ হলেই সাংবাদিকদের ওপর আটক আইন প্রয়োগের ঘটনার প্রতিবাদ করাটা খুব জরুরি। কারণ ইতিহাস বলে, পরবর্তীকালে এই ঘটনাটা যে কোন অপছন্দের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই ঘটতে পারে। কাজেই এই জরুরি প্রতিবাদটুকু আমাদের করতেই হবে। আমরা কোনভাবেই বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। অন্তত কালো ব্যাজ পরে একটা প্রতিবাদ মিছিল তো করতে পারেন কলকাতার সাংবাদিকরা। দেশজুড়ে এমন প্রতিবাদ দেখলে শাসকরাও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দু-বার ভাববেন। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আটক আইন প্রয়োগের ঘটনার প্রতিবাদ না করা মানে তাকে সমর্থন জানানো।
মণিপুরের এই ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাই আমাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। অন্যায় দেখেও প্রতিবাদ না করে শাসকরা পাশ ফিরে শুতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকরা তা পারেন না। কারণ মানুষের অধিকার, বিশ্বাসগুলি যাতে কোনভাবেই ভঙ্গ না হয় তার জন্য সতর্ক পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু সাংবাদিকদের। এই দায়িত্ব পালনে যেন কোন বিচ্যুতি না আসে। সতর্কতাই গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষার মূলমন্ত্র। ভগবান নিদ্রা যেতে পারেন কিন্তু গণতন্ত্রকে জাগিয়ে রাখতে হয়। আর কিশোরচন্দ্রের মত সাংবাদিকরা অতন্দ্র প্রহরীর মত তাকে জাগিয়ে রাখার কাজটিই করে চলেন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )