বিজেপির দুর্গ গোবলয়েই বিজেপি ধরাশায়ী। হাতছাড়া মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্রিশগড়- গোবলয়ের তিন রাজ্যই। নূন্যতম ছাপ ফেলতে ব্যর্থ তেলেঙ্গানা ও মিজোরামে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে গুরুত্বপূর্ণ এই বিধানসভা নির্বাচন গুলোয় ভরাডুবি বিজেপির জন্য দুর্যোগের ইঙ্গিত দেয়। গত কাল থেকে ভারতের রাজনীতি অন্য এক মোড় নিল, এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ।
রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় ছিল না। ধর্ম বিদ্বেষ ও গরু রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। সরকারের দখল ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’দের হাতে, সরকারের কাজে ‘উন্নয়ন’ বলে কোনো শব্দ নেই, মানুষ অস্তিত্বহীন বিজেপির সব কিছুতেই। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা ও তার সমাধান নয়, রাম মন্দির হয়ে উঠেছে ভোটের মূল ইস্যু। রাষ্ট্রের ভালোর নামে মোদি একের পর এক কাজে মানুষকে ‘গাধা’ বানিয়েছে, সেখান থেকে গোবলয়ে বিজেপির ভরাডুবি রাষ্ট্রের মানুষের কাছে যেন শাপমুক্তি। গতকাল থেকেই কোটি কোটি মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে, এবার হয়ত উগ্র হিন্দুত্ববাদের হাত থেকে মুক্তি! ভারত হয়ত আর ‘হিন্দু’ পাকিস্তান বা সিরিয়া হবে না।
বাংলাতেও এই ফলের ছাপ পড়বে, ইতিমধ্যেই মুষড়ে পড়েছে রাজ্য বিজেপি। বিজেপিকে বাংলায় দু একটা আসন বাড়াতে গেলেও এবার অনেক ঘাম ঝড়াতে হবে, শুধু ধর্মের নামে রক্ত ঝড়িয়ে হবে না। তাই অনেকেই আত্মহারা!
আমি বলব, একটু শান্ত হোন, এটা মানুষের জয় বটেই। কিন্তু ২০১৯ বাকি এখনও, খেলা অনেক বাকি। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তি থাবা বসিয়েছে, মাইন্ড স্পেস দখল করেছে যুব সমাজের। আর এস এস, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও নানা নামে হিন্দুত্ববাদীরা ডানা মেলেছে ভারত জুড়ে, এ বাংলাতেও তাদের শাখা অনেক বেড়েছে। তারা নিশ্চিত ভাবে ঘাস কাটতে গজিয়ে ওঠেনি। তাই আগামী ছয় মাসে কি হবে কেউ জানে না। কোনঠাসা বিজেপি মরন কামড় দেবে, সজাগ থাকতেই হবে। বিজেপির মেশিনারি গতকাল হারের পর নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যায়নি, টাকাও কম নেই, আর ‘কুখ্যাত’ আইটি সেল তো আছেই। তাই লড়াই এখনও বাকি। আমাদের আত্মবিশ্বাসের দরজায় সাম্প্রদায়িক শক্তি লাথি কষাতে না পারে, খেয়াল রাখতে হবে।
বিজেপি গত কয়েকবছরে কিছু জিনিস সাফল্যের সাথে করেছে। রাজনীতির ধারণা ও সংজ্ঞা অনেকটা বদলে দিয়েছে। প্রতিটা দলই প্রায় ‘হিন্দুত্ব’ কে আঁকড়ে ধরেছে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে। তাই ধর্ম নিরপেক্ষতা না, রাজনীতির বেস লাইন পরিবর্তিত হয়ে এখন হয়েছে ‘নরম’ হিন্দুত্ব। মধ্যপ্রদেশ বা রাজস্থানে কংগ্রেস কোনো গণ আন্দোলন করেনি। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণে হেরেছে বিজেপি, জেতেনি কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ইস্তেহারে গরু ছিল, ছিল গোবর-গোমূত্রও। রাজস্থান ও গুজরাটে কংগ্রেস ও বিজেপির তফাৎ সূক্ষ্ম। তাই ২০১৯ এ বিজেপি হারলেও তাদের কিছু জিনিস রয়ে যাবে, ক্ষত মেরামতির দিকে যাবে না কোনো দলই। বাংলায় আর এস এস, বজরং দল যেভাবে বেড়েছে, চিন্তা থেকে মুক্তি সম্ভব? তাদের উৎখাতের দায়িত্ব কে নেবে? বাংলার সরকার ও অন্যান্য দল গুলো সাম্প্রদায়িকতাকে উপড়ে ফেলতে এগিয়ে আসবে? কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় তখনও বড় বড় দাঙ্গা হয়েছে, করেছে এই আর এস এস ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গুলি, করেছে মুসলমান সাম্প্রদায়িকরাও। তাই আর এস এস বাড়ার সুদূরপ্রসারী কুপ্রভাব আছে। আর এস এস সামাজিক সমীকরণ বদলে দেয়, সমাজটাই অন্য ভাবে চালিত হয়। আমাদের মুক্তি দরকার এই সামাজিক অভিশাপ থেকেও। শুধু বিজেপি না, হারাতে হবে বিজেপি মানসিকতাকেও।
বিজেপি ভারতের জন্য অভিশাপ, মানবতার শত্রু। তাই আশু কর্তব্য অবশ্যই ২০১৯ সালে বিজেপিকে ছুঁড়ে ফেলা। কিন্তু বিজেপিকে হারাতে অনেকে দলই ‘তুলনামূলক ভালো’ বিজেপি হয়ে গেছে, তার বিরুদ্ধেও লড়াই দরকার। লড়াই থেমে থাকে না, থামবেও না। চলবে যতদিন না পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাস্ত হয়।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )