বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে দেশের সেরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘সক্ষমতা’ রয়েছে। কোনও কট্টর তৃণমূলী নন, তৃণমূলের মঞ্চে এসে রবিবার এই সব মন্তব্য করে গেলেন দেশের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশবন্ত সিনহা। এর পাশাপাশি বাজপেয়ী জমানার এই অর্থমন্ত্রী তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকারের অর্থনীতিকে। তাঁর মতে, মোদীও আসলে ‘তুঘলক’। মোদী আসলে একটা ‘বোকা’।
‘আইডিয়া অব বেঙ্গল’— তৃণমূলের ডিজিটাল সেল আয়োজিত অনুষ্ঠানের পোশাকি নাম ছিল এটাই। সেখানেই সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকা রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা তথা সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যশবন্তের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘আর একটা শেষ লড়াই আমার বাকি আছে।’ যা ইতিমধ্যেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
‘কালো টাকা এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গ’— চর্চার বিষয় ছিল এই। ফলে নরেন্দ্র মোদীর কঠোর সমালোচক যশবন্ত অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন আলাপচারিতায়। ডেরেক-যশোবন্ত আলাপচারিতায় প্রথমেই আসে নোটবন্দীর প্রসঙ্গ। ডেরেক মনে করান নোটবন্দির কথা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করার ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় পর পর সাতটা টুইট করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছিলেন, পদক্ষেপ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন।
ডেরেকের কথা মেনে নিয়েই এরপর যশবন্ত বলেন, ‘ওইদিন আমি সত্যিই অবাক হই মোদীর এমন সিদ্ধান্তে। অর্থনীতিবিদরাও বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলেন। তাঁরাও সেই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলেন না, এর ফল দেশের অর্থনীতির জন্য ভাল হবে, না খারাপ। কিন্তু বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনই টের পেয়ে গেছিলেন যে এই নোটবন্দীর ফলে কোপ পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এ জন্য তাঁকে কুর্নিশ।’
এরপরই মোদীর ওই পদক্ষেপকে কটাক্ষ করে যশবন্ত বলেন, ‘নোটবন্দীকে কখনই অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখবেন না। ওটা আপাদমস্তক রাজনৈতিক পদক্ষেপ।’ সে প্রসঙ্গেই মহম্মদ বিন তুঘলকের কথা টেনে আনেন দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। এমন আক্রমণাত্মক মন্তব্যের আঁচ পেয়েই তাঁর কাছে ঝানু রাজনীতিবিদ ডেরেকের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীকে কি তুঘলকের সঙ্গে তুলনা করছেন তিনি? দ্বিধাহীন যশবন্তের জবাব, ‘অবশ্যই। তিনি তুঘলকই। নোটবন্দীতেই সেটা প্রমাণ হয়েছে।’
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মোদী কালো টাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আম জনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে ঢোকানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। সে প্রসঙ্গ উঠতেই আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে যশবন্ত বলেন, ‘ওই সময় অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন ১৫ লক্ষ টাকার বিষয়ে। আমি বলেছিলাম, বোকারা এই রকম প্রতিশ্রুতি দেয়।’ আপনি কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘বোকা’ও বলছেন? আবারও ঝটিতি প্রশ্ন ডেরেকের। যশবন্তের সুকৌশলী জবাব, ‘তখন উনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন।’
দরজায় কড়া নাড়ছে লোকসভা নির্বাচন। তবে তিনি যে মোদী সরকারের বিরোধিতাই করবেন, তা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন দলত্যাগী যশবন্ত। তাঁর অভিযোগ, বর্তমান সরকারের আমলে একের পর এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব শেষ করে দেওয়া হয়েছে। ক্যাবিনেট, সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সিবিআই, তথ্য কমিশন— সব প্রতিষ্ঠানকে খর্ব করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
মোদী সরকারে নামেই এতগুলি মন্ত্রক। কিন্তু ক্যাবিনেট বলে যে আদৌ কিছু নেই, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যশবন্ত বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী জানতেন না যে, নোটবন্দি হচ্ছে। রাফাল চুক্তি নিয়ে অন্ধকারে ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। জম্মু-কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির সরকার থেকে সমর্থন তোলার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুই জানতেন না। আর বিদেশমন্ত্রীর অবস্থা তো আপনারা সবাই জানেন।’
বাজপেয়ী জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সহকর্মী মমতা কেমন ছিলেন? জানতে চেয়েছিলেন ডেরেক। উত্তরে যশবন্ত একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, ‘১৯৯৯ সাল, ডিসেম্বরের শেষ দিক। কাঠমান্ডু থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান অপহরণ করে কন্দহরে নিয়ে গিয়েছে জঙ্গিরা। জরুরি বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। বৈঠকে ঢোকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কিছু কথা হল। তার পরে বৈঠকে মমতা বললেন, যশবন্তজির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। আমরা দু’জন কন্দহর যেতে প্রস্তুত। আমাদের পণবন্দি হিসেবে আটকে রাখুক। বিমানের যাত্রীদের ছেড়ে দিক।’
যশবন্তের মুখে এই আখ্যান শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন ডেরেক। সে বিস্ময়কে প্রশ্রয় দিয়ে মমতার প্রশংসায় মেতে ওঠেন যশবন্ত। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাটা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা একাধিক বার উচ্চারণ করেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তবে কি তৃণমূলের হয়ে প্রচার করবেন তিনি? যশবন্তের ঝটিতি জবাব, এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করার জন্য তাঁকে যেখানে ডাকা হবে, সেখানেই যেতে রাজি তিনি।
এরপরই যশবন্তের ঘোষণা, ‘২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পরে আমি পাকাপাকি ভাবে রাজনীতি থেকে অবসর নেব।’ মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাই তাঁর ‘শেষ লড়াই’, তৃণমূলের ডিজিটাল সেলের অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকেই তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী।