হাঙ্গেরিয়ান লিজেন্ড ফেরেঙ্ক পুসকাস বলেছিলেন “সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন আলফ্রেডো ডি স্টেফেনো। আমি পেলেকে এই তালিকার বাইরে রাখছি। কারণ তিনি এসবের উর্ধ্বে।”
সময়টা ১৯৬৭ সাল , গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত নাইজেরিয়া। শুধুমাত্র এই একটি মানুষকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল! তিনি ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো’। নামটা রাখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিল রেখে। যাকে দরিদ্র পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়।
ফুটবলে সহজাত প্রতিভা ছিল তার। কিন্তু ফুটবল কেনার টাকা কোথায় পাবেন! মোজার ভেতরে কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চালাতেন অনুশীলন। কিন্তু উপরওয়ালার দয়াতেই হয়তো মাত্র ১৫ বছরের পেলের উপর নজর পড়ে সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে নিয়ে যান সান্তোস ক্লাবে এবং সান্তোসের ‘বি’ টিমে তাকে সুযোগ দেন। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মাঝে সান্তোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন তিনি।
সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে সান্তোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন তিনি। সেবারের ব্রাজিলিয়ান লীগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিলো যে, তা স্বয়ং ব্রাজিল সরকারেরও চোখ এড়ায়নি। পেলের এই পারফর্মেন্স তাদের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হলো। তাই আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল! রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো জায়ান্টরা তাকে দলে নিতে চাইলেও সরকারের অনুরোধে ইউরোপিয়ান লীগে পেলের কোনো দিন খেলা হয়নি। তখন ইউরোপে খেললে স্বাভাবিকভাবেই অনেক টাকা আয় করা যেত, কিন্তু সরকারের অনুরোধে দেশের স্বার্থে সেটা হাসিমুখে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ডটি করতে ভুল করেননি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে তিনি অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড। পুরো ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯২টি হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৭৭ গোল), ক্যারিয়ারে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ গোল- এই পরিসংখ্যানগুলো তার অর্জনের খুব সামান্যটুকুই বোঝাতে পেরেছে।
পেলের যুগে ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকে ‘ব্যালন ডি অর’ সম্মাননা দেয়ার নিয়ম ছিল না। ২০১৬ সালে ব্যালন ডি অর এর ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৫ সালের আগে পর্যন্ত ইউরোপিয়ান নন এমন খেলোয়াড়দেরকেও বিবেচনায় এনে নতুন করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় । এখানে পূর্ববর্তী ৩৯টি ব্যালন ডি অর-এ ১২টি পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৪ আর ১৯৭০ এর ব্যালন ডি অর জয়ী ঘোষণা করা হয় পেলেকে। তবে সম্মানের জন্য আগের খেলোয়াড়দের নামও রাখা হয়।
এছাড়াও আরও অনেক পরিসংখ্যান আছে সেদিকে আর যাচ্ছিনা। এবার অভিযোগের পালা। পেলের সম্পর্কে অনেকের একটা অভিযোগ আছে যে, তিনি ইউরোপীয় ফুটবলে কখনো খেলেননি, যা কিনা তার জন্য একটা সীমাবদ্ধতা। তিনি ইউরোপে খেলেন নি, কিন্তু ইউরোপে তার পারফর্মেন্স বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। জাতীয় দল ছাড়াও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে তো তার পারফর্মেন্স মুগ্ধ করার মতো। তবে এগুলো ছাড়াও পেলের আরো কিছু ম্যাচ আছে ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে। এসব দলের বিপক্ষে ১৩০ ম্যাচ খেলে পেলের গোল ১৪২ টি।
আমি মারাদোনার খেলা কিছুটা দেখেছি, মনে হয়েছে, এর চেয়ে ভালো খেলা আর কীভাবে সম্ভব? পেলের খেলা দেখিনি, তবে পেলে যদি মারাদোনার চেয়েও ভালো খেলে থাকে, তাহলে আমাকে বলতেই হবে ‘ওয়াও’। একই সাথে বিচার করার সময় আবেগ সরিয়ে সবাইকে বাস্তববাদীও হতে হবে। পেলে সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন ১৯৭০ সালে, এতদিন পরেও বিশেষজ্ঞদের যেকোনো তালিকায় প্রথম নামটা পেলেরই থাকে। ২য় থেকে ১০ম ক্রমে অনেক নাম পরিবর্তন হয়। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অনেক যুক্তিই দেখানো যাবে, কিন্তু এক নম্বরটা অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতেই সবার চেয়ে অনেক খানি এগিয়ে থাকেন পেলে। ২০০০ সালে IFFHS (International Federation of Football History & Statistics) এর তত্ত্বাবধানে সাবেক খেলোয়াড় আর সাংবাদিকদের ভোটে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়। তাতে ১৭০৫ ভোট পেয়ে পেলে প্রথম হন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা ক্রুয়েফ পান ১৩০৩ ভোট।
শুধু ফুটবলারই নন, জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী এক যোদ্ধার নাম পেলে।