কালবেলা নেমে আসছে সরকার বাড়ির এবেলা নামক দৈনিক ট্যাবলয়েডটিতে। আগামী ১৫ই ডিসেম্বর থেকে সাদা বাড়ি কালো গ্রিলের প্রাক্তন কর্ণধার অভীক সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত এই কাগজটি বন্ধ হয়ে যাবে বলে কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন। একটা কাগজকে ঘিরে জড়িয়ে থাকে অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রতিশ্রুতিবান তরুণ তরুণীর ফুটে ওঠার আকাঙ্খা, অনেক পরিবারের রুটি-রুজি। তা নিশ্চয় বেদনাদায়ক, কিন্তু আরও বেদনাদায়ক হল ক্রাইম থ্রিলারের মত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ঢঙে যেভাবে কর্মীদের বিষয়টি জানানো হল এবং ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হল। এটা লিখে জানানোর মত ভাষা আমার নেই, তাই যা ঘটেছে প্রাক্তন সহকর্মীদের কাছ থেকে শোনা সেই বিবরণটুকুই শুধু আমি আপনাদের জানানোর চেষ্টা করলাম। দীর্ঘ ৩৫বছরেরও বেশি সময় আমি খবরের কাগজে কাজ করেছি। এমন নির্মমতা ও অন্যায় আমি আর কোথাও দেখিনি। সরকার বাড়ি যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার কথাটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অফিসের মিটিং রুমে একের পর এক ডেকে পাঠানো হল কর্মীদের। তাদের লিখিত কোন নোটিশ বা চুক্তিপত্র দেওয়া হল না। অফিসের এইচ আর বিভাগের জনৈক প্রতিনিধি জানালেন, আগামী ১৫ই ডিসেম্বর থেকে �এবেলা� বন্ধ হয়ে যাবে। আপনারা তার আগে নিজেরাই রেজিগনেশন লেটার লিখে চাকরি ছেড়ে দিন। অফিস কর্মীদের কথা ভাবে, তাই আপনাদের ৬ মাসের বেসিক বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। প্রতিদিন সংগ্রাম, সততা, ন্যায়, নীতি, সহমর্মিতা, সমবেদনা ও মানুষের পাশে থাকার ফিরিস্তি পেশ করে যে কাগজগুলি ভোরবেলা আপনার বারান্দা বা দরজার সামনে আছড়ে পরে সেই কাগজ কর্তৃপক্ষের আঁটঘাট বেঁধে কর্মীদের বঞ্চিত করার এই পরিকল্পনাটি হিন্দি ছবির ভিলেনদের মত। আপনি ভেবে দেখুন, এমনভাবে কর্মীদের কাছে ব্যাপারটা পেশ করা হল যাতে তারা নিজেরাই চিঠি লিখে পদত্যাগ করেন। তাহলেই আর ছাঁটাই করার দায় থাকবে না। আপনার চমকানো কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি।
গোটা প্রক্রিয়াটির সময় আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন আপাতভদ্র ও পরিচ্ছন্ন, ভাবমূর্তির মানুষ বলে বহু বিজ্ঞাপিত আনন্দবাজার ও এবেলার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় এবং আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক ঈশানী দত্ত রায়। এই সম্পাদক মশাই অনেকের চোখে র্যাডিক্যাল, প্রগতিশীল, কর্মীবান্ধব ও উদারমনস্ক বলে পরিচিত। কেউ কেউ তাকে কিঞ্চিৎ বামঘেঁষাও বলে থাকেন। যদিও �এমনও হয়, অমনও হয়� মার্কা পন্ডিতী ছাড়া তার লেখায় স্পষ্ট কোন দিশা থাকেনা। এইচ আর বিভাগের কর্মীটি যখন একের পর এক ডেকে নেওয়া কর্মীদের তার �হিতপোদেশ� শোনাচ্ছিলেন তখন অনির্বাণ নাক খোঁটার মত মোবাইল খুঁটছিলেন। আর ঈশানী বাধ্য ছাত্রীর মত ঘাড় নাড়ছিলেন বলে আমাকে এই বধ্যভূমিতে ডাক পাওয়া এবেলার প্রাক্তন সহকর্মীরা জানিয়েছেন। দুজনের কেউ একটি কথাও বলেননি। ঈশানী দেখছি অতি দ্রুত কর্পোরেট হাবভাব বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। অথচ এই দুজনেই ছিলেন একসময় তাদের টিম লিডার। প্রাক্তন সহকর্মীরা বললেন, চটকলের মজদুরদেরও এর থেকে ভদ্রভাবে ছাঁটাই করা হয়। চাকরি পাওয়ার সময় সবাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সই করে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিদায়ের সময় অফিসের তরফে কাগজপত্রের কোন ব্যাপারই রইলো না।
আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। চিফ ফোটোগ্রাফার হিসেবে আমাকে আনন্দবাজার থেকে এবেলায় নিয়ে এসেছিলেন পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক অভীক সরকার। আমি জানি যাদের এভাবে বিনা কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল তাদের কারও বাবা মা অসুস্থ, কারও স্ত্রী গর্ভবতী, কারও ছেলেমেয়েদের স্কুল এখনও শেষ হয়নি। এরা কিন্তু কেউই পিছনের দরজা দিয়ে একে তাকে ধরে সরকার বাড়ির ফটক পেরিয়ে কাগজে ঢুকে পড়েন নি। রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে ও দিনের পর দিন লেখা, ছবি, প্রতিবেদন, সম্পাদনার যোগ্যতা দিয়েই কাজ পেয়েছেন এবং টিঁকে গেছেন। এদের মার্কশিটও যথেষ্ট ভাল। বড় কাগজে কাজ করার স্বপ্ন চোখে নিয়েই তারা সাদা বাড়ি কালো গ্রিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অনধিকার চর্চা হবে তবুও বলি, এদেরকে কী কোনভাবে আনন্দবাজারে পুনর্বাসিত করা যেত না? কাগজ যদি না চলার জন্য বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অনির্বাণ বা ঈশানী সেই ব্যর্থতার দায় নেবেন না কেন? কী বিরাট অবদানের জন্য তারা আনন্দবাজারের শীর্ষস্থানে বসে আছেন? সেই প্রশ্নও কিন্তু উঠবে।
অনির্বাণের প্রসঙ্গে একটা পুরনো ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। এই মানুষটি আদতে কতটা মেরুদণ্ডহীন এই ঘটনাটি তার একটা বড় প্রমাণ। আনন্দবাজারেই অনির্বাণের সহকর্মী ছিলেন কবি প্রমোদ বসু। হাওড়ায় থাকতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আনন্দবাজারে লেখা হল এক বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেছেন, তার নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হল না। অথচ দেশ, কৃত্তিবাসসহ বহু লিটল ম্যাগাজিনের লেখক প্রমোদ বসুর কবি হিসেবেই একটা পরিচিতি ছিল। অনির্বাণ সবকিছু জেনেও এই ঘটনার কোন প্রতিবাদ করেন নি। খবর পেয়ে আমি নিজেই শ্মশানে উপস্থিত হয়েছিলাম। পরে দেখলাম আনন্দবাজারের চিত্র সাংবাদিক রণজিৎ নন্দী ছাড়া অফিসের আর কেউ আসেননি। ছোট ঘটনা মানুষকে চিনিয়ে দেয়, তার প্রগতিশীলতার দৌড় সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম।
আমি জানি কর্তৃপক্ষের আমার মত একজন প্রাক্তন আনন্দবাজারীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় নেই। কিন্তু তবুও আমি বলব। কারণ, আমি জানি যারা বছরে দুটো ভাল কপিও লেখেননা, মালিকদের নির্দেশ অনুযায়ী কোন কিছু আদায় করার জন্য এর তার কাছে ভাল জামা প্যান্ট পরে হাজির হয়ে দালালি ছাড়া আর কিছুই করেন না তারা কিন্তু বহাল তবিয়তে আছেন। কারণ তারা কাজ নয় তোষামোদটুকুই জানেন। তোষামোদ করতে জানেন বলে মহিলা সহকর্মীরা অনেকের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করা সত্বেও এখনও তারা বহাল তবিয়তে অফিসে বিরাজ করছেন। সাংবাদিক হিসেবে তাদের যোগ্যতা কেমন তাও সবাই জানেন। আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী আলোকচিত্রী বলছিলেন, নানা পুরনো কথা। তিনিও দীর্ঘদিন কাজ করার পর বঞ্চিত হয়েই আনন্দবাজার ছেড়েছেন। তিনি বলছিলেন, ভবানীপুর থানায় একবার একটি কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। উত্তেজিত স্থানীয় মানুষ থানার বোর্ডের গায়ে থানা কথাটিকে মুছে লিখে দেন ভবানীপুর পতিতালয়। আনন্দবাজারের হালচাল দেখে তারও বাড়িটার গায়ে আনন্দ…লিখে দিতে ইচ্ছে করে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি এই কাগজের আলোকচিত্রীদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। নিজের পয়সায় লক্ষাধিক টাকা খরচ করে ক্যামেরা, লেন্স ইত্যাদি কিনতে হয়। তারও ১৫বছর পর কেউ হন স্ট্রিঙ্গার, পরবর্তীকালে এদের দু একজনের ভাগে স্টাফ হওয়ার শিকে ছেঁড়ে। অবসরকালীন সুবিধা পাওয়া যাবে স্টাফ হওয়ার পরেই। কেউ ২৮বছর ধরে কাজ করলেও তার অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা দাঁড়াবে হয়তো ১২বছর। কারণ ঐ সময়টুকুই তিনি স্টাফ ছিলেন। কিছুই করেন না এমন আলোকচিত্রী এখনও আনন্দবাজারে আছেন শুধু তেল দেওয়ার যোগ্যতাতেই। জেলার অবস্থা আরও করুণ। কোথাও আলোকচিত্রীদের ক্যামেরা দেওয়া হয়েছে, কোথাও হয়নি। নিজেরাই ক্যামেরা, লেন্স কিনে বছরের পর বছর আনন্দবাজারে ছবি দিয়ে চলেছেন। আশা কোনদিন সরকার বাড়িতে চাকরি হবে। অনেকের অবশ্য আনন্দবাজারে ছবি ছাপা হয় বলে কিঞ্চিত গর্বও আছে।
এত বড় অন্যায়ের কথা লিখতে লিখতেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। ২০১২র ১৭ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল এবেলা। তৎকালীন সম্পাদক অভীক সরকার মিটিং এ বলেছিলেন, বড় কাগজ এখন আর মানুষ পড়তে চাইছেন না। আমাদের নতুন কাগজ পাঠকদের এই পছন্দকে ধরতে চাইবে। আপনাকে ফোটোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব নিতে হবে। কত নতুন ভাবনাচিন্তা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এ কাগজ শুরু হয়েছিল। প্রতিটি কর্মী প্রাণ ঢেলে কাজ করছিলেন। আমার সঙ্গে আনন্দবাজার থেকে আর একজন এসেছিলেন রিপোরটিং এর কোঅর্ডিনেশনের দায়িত্ব নিয়ে। তিনি এখন এবেলা ছেড়ে আর কোথাও খাপ খুলতে না পেরে� আরেকটা কাগজে গিরগিটির মত ঘাপটি মেরে বসে আছেন। অভীক সরকার সরে যাওয়ার পর থেকেই লক্ষ্য করলাম এবেলা কেমন যেন দুয়োরানি হয়ে গেছে। কাগজটা কেমন যেন দিশাহীন। আমি অবশ্য তার আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কাগজের পরিচালকমণ্ডলী তাদের নিজেদের পরিকল্পনার ব্যর্থতার দায় এই কর্মীদের ওপর চাপাবেন কেন? কাগজ সফল হলে তা সম্পাদকের কৃতিত্ব আর ব্যর্থতার ধুয়ো তুলে কাগজ বন্ধ করার দায় শুধু কর্মীদের ওপর চাপানো কেমন ডায়লেক্টিস অনির্বাণ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস কর্মীদের ব্যর্থতায় কাগজ না চলা নয়, এবেলা বন্ধ হচ্ছে মালিকদের পলিসিগত কারণেই। এই প্রডাক্টটাকেই পণ্য হিসেবে বাতিল করেছেন মালিকরা। কর্মী সঙ্কোচনের কথাও বলা যাবে না কারণ, আনন্দবাজারে লোক নেওয়া চলছে। একটা কথা মনে রাখবেন, এবেলার এই কালো মেঘ কিন্তু সরকার বাড়ির আকাশ থেকে এত তাড়াতাড়ি সরবে না, তা আপনাদেরও স্পর্শ করবে। অনির্বাণ দীপশিখা তখনও জ্বলবে তো?
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )

