রথ বলতে বোঝায় যুদ্ধযান। আবার বীরদেরও ‘রথ’ বলে ডাকার রেওয়াজ ছিল এক কালে, যেমন-অতিরথ, মহারথ ইত্যাদি। সনাতন ধর্মে ‘রথ’ আসলে মানব শরীর। আর রথযাত্রা হল মানুষের জীবনের পথ, সেই যাত্রাপথের চার চাহিদা—ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই মোক্ষ ব্যক্তির নয়, সমষ্টিগত মুক্তি। দুঃখ-দুর্দশা থেকে নিবৃত্তি। তার প্রথম ধাপ হল নৈতিকতা বা ধর্ম।
সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দল বঙ্গের কয়েকটি জায়গা থেকে রথযাত্রা বের করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এখন তো রথের সময় নয়; তবে কেন এই অকাল যাত্রা! উত্তর হল, মুনাফা; ধর্ম নয়। ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলটি ধর্ম-বিদ্বেষের হাত ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকতে চায়। তাতে লাভ হল দুটি—এক, বিনা শ্রমে ক্ষমতা লাভ এবং দুই, দেশের মানুষকে অধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখা।
ধর্ম কী, সনাতন ধর্মে মানুষকে কী মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে এই দলটি মোটেই উদ্গ্রীব নয়। জীবকে শিবজ্ঞানে সেবা না করে তাকে অকুল পাথারে ফেলে দিয়ে নাকানিচোবানি খেতে দেখলে ওই রাজনৈতিক নেতাদের ধর্ষকামী চরিত্র সিদ্ধ হয়। সেবা নামক ধর্মের বদলে এরা ‘অত্যাচার’ নামক চাবুক তুলে নিয়েছে হাতে। তারই ফলশ্রুতি এই রথ, তাই এই যুদ্ধযান।
ওদিকে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে ২৬ বছর। সেখানে মন্দির বানানোর হুঙ্কার ওঠে নির্বাচনের ঢোল বাজলেই। ওদিকে উন্নয়নের জয়রথ মুখ থুবড়ে পড়ছে পেট্রোপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে। নানা রকমের কেলেঙ্কারি আর ধনীর ক্রমশ পুষ্ট হওয়া থেকে বোঝা যায় এই অতিরথের কাণ্ডারীদের আসল উদ্দেশ্য। মানুষ কাজ পাচ্ছেন না, কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, দালাল আর ফড়ে খেয়ে নিচ্ছে যাবতীয় সুখ আর ঐশ্বর্য। উদার বৈষম্যের এই পড়ন্ত বিকেলে মুনাফাখোর রাজপুরুষরা বৈশ্যদের গোলাম হয়ে পথে নামছে মহারথ নিয়ে।
অথচ রথযাত্রা একটি পবিত্র বিষয়। বলরাম, সুভদ্রা এবং জগন্নাথের রথযাত্রায় আছে গুরুভক্তি ও পরম ঈশ্বরের ভাব। রাজনৈতিক দল সেই পবিত্রতা নষ্ট করে শুধু কলা বিক্রি করতেই অতিশয় মনোযোগী। ওদিকে গরুর প্রাণ রক্ষার জন্য মানুষ বলি দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। শাস্ত্রের গোমেধ নয়, এখন অশাস্ত্রীয় নরমেধ হল রাজনীতির কারবারীদের পরম লক্ষ্য।
ধর্ম বা নৈতিকতা আসলে অর্থ বা বিষয়কে বৈধ পথে নিয়ে আসে। কৌটিল্য অবশ্য উলটো কথা বলেন। ধর্ম-অর্থ একযোগ হলে মানুষের কামনা-বাসনার নিবৃত্তি হয়। সে ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করে, গান-বাজনা শোনে। কিন্তু পেটে যখন অন্ন নেই আর রোজ যে দেশে শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি, সেই দেশে মানুষ ক্রমশ অস্থির থেকে অস্থিরতর হচ্ছে, তার যাবতীয় সুকুমার বৃত্তি নষ্ট হতে চলেছে, তখন বেরোয় ওই রাজরথ, তাকে পিষ্ট করে দিতে। যে তারাপীঠ থেকে রথের সূচনা হবে সেই পীঠের সাধক বামা ক্ষ্যাপা ছিলেন ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে, যে গঙ্গাসাগর থেকে রথের যাত্রা হবে সেই গঙ্গাসাগরের কপিল মুনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী এবং সম্প্রীতির পূজারী। তাঁদের অপমানও হবে এই রথযাত্রায়।
দেবতা থাকেন ঘরে, মনের মন্দিরে। আয়ুর্বেদশাস্ত্র বলে, শরীর হল মন্দির। তার ২০৬-টি হাড় আছে। রথ তৈরি হয় ২০৬-টি কাঠের টুকরো দিয়ে। তাই রথ আসলে মানবদেহের প্রতীক। মানুষকে অবজ্ঞা করে, তার ঈশ্বরত্বকে ছোটো করে, ধর্মের নামে তাকে খুন করে প্রতিনিয়ত মনুষ্যত্বকে জবাই করে যারা কাঠের রথ বের করে আবারও পুঁততে চায় বিদ্বেষের চারাগাছ, তাদের ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
( মতামত ব্যক্তিগত )