ভারতের ইতিহাসে বিনয়-বাদল-দীনেশ এই ত্রয়ীর নাম সবসময়েই স্বর্ণাক্ষরে লেখা। দেশের প্রতি তাঁদের আত্মত্যাগ ভারতবাসীর মনে তাঁদের চিরস্মরণীয় আসন দিয়েছে। দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন যারা তাঁদের মধ্যে এই তিনটি নাম থাকে একদম প্রথমের দিকেই।
বিনয়-বাদল-দীনেশ এই তিন নামের সাথে যে তারিখটি ভীষণ ভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে তা হল ৮ই ডিসেম্বর। ১৯৩০ সালে এই তারিখেই বিনয়-বাদল-দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিং-এ বা বলা ভাল ইংরেজ শাসনের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে সম্মুখ যুদ্ধে হত্যা করেন। যে যুদ্ধ ইতিহাস মনে রেখেছে ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে।
ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারে ভারতবাসী তখন মৃতপ্রায়। আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে অনেকদিনই, ইতিমধ্যেই দেশের জন্য প্রাণও দিয়েছেন অনেকেই। এরকমই সময়ে দেশকে স্বাধীন করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন এই তিনজন। যে কোনও পন্থায় তখন বিপ্লবীরা চাইছেন দেশের স্বাধীনতা। তাঁরা মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেন না বলেই তাঁদের আত্যত্যাগে এসছিল মুক্তি। খুব সাধারণ ঘর থেকে আসা এই তরুণেরা দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতেও পিছপা হননি। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জন্ম হয় ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর তদনীন্তন ঢাকার যশোলঙে। গৌরীপুরের পাঠশালাতেই দীনেশের শিক্ষারম্ভ। বাল্যকাল থেকেই দীনেশ ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। এই সময় থেকেই তাঁর মনে স্বদেশ চেতনা ও ব্রিটিশ বিরোধিতার আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছিল। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ১৯২৮ সালে দীনেশ ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’-এর কলকাতা সেশনের প্রাক্কালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস সংগঠিত ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগদান করেন। শীঘ্রই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স একটি সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠনে পরিবর্তিত হয় এবং কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ১৯১২ সালে ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাদল গুপ্ত। স্কুলে পড়ার সময় বাদল বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে আসে | তাঁর সান্নিধ্য থেকেই বাদল গুপ্ত স্বদেশি রাজনীতি সঙ্গে জড়িয়ে পরে | নিকুঞ্জ সেন ছিলেন বিপ্লবী দলের সদস্য | এই শিক্ষকের হাত ধরেই খুব সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাদল গুপ্ত ‘ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ‘( বি.ভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন৷ অল্পদিনের মধ্যেই বাদল এই সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেন৷ ১৯০৮ সালের ১১’ই সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভাগ গ্রামে বিনয় কৃষ্ণ বসু জন্ম গ্রহণ করেন। ‘মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে তিনি ঢাকার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং যুগান্তর দলের সাথে জড়িত হন। বিনয় ও তাঁর সহযোদ্ধারা ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ‘ দলে যোগ দেন ১৯২৮ সালে৷ ১৯৩০ সালের ৯’ই আগষ্ট সাধারণ বেশভূষায় নিরাপত্তার গন্ডিকে ফাঁকি দিয়ে অত্যাচারী ইন্সপেক্টর লোম্যনের খুব কাছে এসে তাকে গুলি করেন বিনয়৷ ঘটনাস্থলেই লোম্যানের মৃত্যু হয়৷ এরপর বিনয় কলকাতায় চলে আসেন৷ তারপরে এই তিন বিপ্লবী একজোট হয়ে দেশের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন।
এনএস সিম্পসন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী এক মানুষ। তিনি কুখ্যাত ছিলেন জেলে বন্দীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য। এই ত্রয়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করার। শুধু সিম্পসনকে হত্যাই নয় তাঁদের লক্ষ্য ছিল কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিস পাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করার। ইংরেজদের বুঝিয়ে দেওয়ার এবার সময় বদলাচ্ছে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দীনেশ তাঁর দুই সঙ্গী বিনয় এবং বাদল ইউরোপীয় পোশাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন এবং সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। ব্রিটিশ পুলিশ গুলি শুরু করে।যার ফলশ্রুতিতে এই তিন তরুণ বিপ্লবীর সাথে পুলিশের একটি সংক্ষিপ্ত বন্দুকযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধই ‘অলিন্দ যুদ্ধ নামে খ্যাত৷ পুলিশ দ্রুতই তাঁদেরকে পরাভূত করে ফেলে। নির্ভীক এই বিপ্লবীরা সহজেই হার স্বীকার করে নিতে চাননি তাই পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়ে আত্যহত্যার চেষ্টা করেন বাদল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু তাঁর। বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের রিভলভারের গুলি নিজদের মাথা লক্ষ্য করে চালান। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের আনা হয় হাসপাতালে। বিনয় ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র তাই মৃত্যুকে কিভাবে বরন করতে হয় তা তিনি জানতেন | তাই ১৯৩০ সালের ১২ ই ডিসেম্বর রাতে বিনয় নিজের মাথার ব্যান্ডেড খুলে ক্ষত জায়গায় আঘাত করে মৃত্যুকে বরণ করেন |
শুরু হয় বিচারপ্রক্রিয়া। মামলার ফলাফল কি হতে চলেছে সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন দীনেশ। ফাঁসির খবরে এতটুকুও বিচলিত ছিলেন না তিনি। বরং নিজের জীবন দেশমাতৃকাকে উৎসর্গ করার গর্বে দীপ্ত ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই তাঁর ফাঁসি হয়ে যায়।
দেশের কাজের জন্য যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা তারা দেখে যেতে পারেননি। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারত যে মুক্তির হাসি হাসতে পেরেছিল তাঁর জন্য এই সমস্ত মানুষদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অংশে বিনয়, বাদল এবং দীনেশকে শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম পালটে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ। অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেলেও আজও এই ত্রয়ীর নামের গুরুত্ব ইতিহাসের পাতায় পাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।