ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে যে সমস্ত বিপ্লবীর নাম উঠে আসে বারংবার তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম অন্যতম। ইতিহাসে বা জনমানসে যিনি বাঘাযতীন নামেই অধিক সমাদৃত।
১৮৭৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে জন্ম হয় তাঁর। মাত্র ৫ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি দিদার বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করেছিলেন বলে তাঁর নাম রটে যায় বাঘা যতীন।
কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ যে অনুরাগ নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তারই প্রেরণায় তাঁর মা শরৎশশী উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁকে। তাঁর মনে দেশপ্রেমের জন্ম সেখান থেকেই হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে জার্মান যুবরাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎ করে তিনি জার্মানি থেকে অস্ত্র ও রসদের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান প্লট তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
বাঘাযতীন সক্রিয় ভাবে দেশের কাজে যোগদান করেন ১৯০৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে শ্রী অরবিন্দের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই। তখন ভারতের চরম দুঃসময়। ইংরেজরা নির্মম নৃশংস অত্যাচারে ভারতীয়দের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। সেই সময়ে ভারতীয়দের লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করার তাগিদে ১৯০০ সাল থেকে মূল অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জেলায় জেলায় যতীন পত্তন করেন এই গুপ্তসমিতির শাখা। পথে-ঘাটে ভারতীয় নাগরিকদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সদা প্রস্তুত যতীনের এই দেশাত্মবোধ ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করত।
তিনি বরাবরই ছিলেন নির্ভীক। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল প্রমুখ চারজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে যতীনের মারপিট হয় শিলিগুড়ি স্টেশনে। এই অপরাধে যতীনের নামে মামলা রুজু হলে সারাদেশে বিপুল হর্ষ জাগে৷ কাগজে কাগজে এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে। ঠাঁট বজায় রাখতে ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে শাসিয়ে দেন, “এমনটি আর যেন না ঘটে!” দর্পভরে যতীন জবাব দেন, “নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করব না, এ শপথ আমি করতে অপারগ।” তিনি ছিলেন বিপ্লবীদের কর্ম শক্তিও। ১৯০৮ সালে বারীণ ঘোষের এক অত্যাচারী সাহেবকে হত্যা করার প্রথম প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন গোপনে শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ দুই প্রধান বিপ্লবী কানে কানে রটিয়ে দিলেন, “ওরে, হতাশ হসনে! যতীন মুখার্জি হাল ধরে আছে!” ২৭ জানুয়ারি, ১৯১০ তারিখে যতীনকে গ্রেপ্তার করা হল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে।
তারপরে শুরু হয় অত্যাচারী ইংরেজদের সাথে বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৯১৫ সালে উড়িষ্যাতে তখন ইংরেজ এবং বিপ্লবীদের সম্মুখ লড়াই চলছে। যতীন তখন সেখানেই এক ধানক্ষেতে গুপ্ত আশ্রয়ে ছিলেন। ইতিমধ্যেই শুরু হয় পুলিশের সাথে গুলির লড়াই। দু’জন বিপ্লবী আত্মসমপর্ণও করেন। সেই যুদ্ধেই তিনি গুরুতর আহত হন এবং বালাসোর হাসপাতালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্তেম্বার মৃত্যু এই বীর বিপ্লবীর। ভারতীয়দের মনে তিনি আজও তিনি অমর, তাঁর এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায়।