সিপিএম রয়েছে সিপিএমেই। বাংলায় ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে আমাদের ভুল হয়েছিল বলে তারা যে কান্নাকাটি শুরু করেছিলেন তা যে স্রেফ লোকদেখানো ব্যাপার ছিল তা প্রমাণ হয়ে গেল সাম্প্রতিক পদযাত্রার সময় তাদের দলের নেতাদের ভাষণে। সেখানে দলের ছোট বড় মাঝারি সব নেতারাই বলে ফেলেছেন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে তারা ঠিকই করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। শিল্পের নামে শয়ে শয়ে কৃষক মেরে, বহু মানুষকে জেলে পুরে তারা যে উন্নয়নের তত্ত্ব ফেরি করেছিলেন মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবুও উদ্ধত, কাণ্ডজ্ঞানহীন এই দলটি সেই সিঙ্গুরকেই তাদের পদযাত্রার সূচনাবিন্দু হিসেবে বেছে নিলেন। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার! আদতে সিঙ্গুর – নন্দীগ্রামে তারা যে সঠিক ছিলেন এই যুক্তিকে মান্যতা দেওয়াই সিপিএমের সিঙ্গুর থেকে রাজভবন অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। তাহলে কমরেড, এত আত্মসমালোচনার নাটকের কী দরকার ছিল? মানুষকে আর কত দিন গাধা ভাববেন আপনারা?
বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করার পর কী করবেন তা ভেবে দিশাহারা ছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। পদযাত্রায় মানুষের একটু মুখ দেখা যেতে না যেতেই আবার ফিরে এসেছে এই বিচিত্র দলটির আরও বিচিত্র নেতাদের পুরনো বাতেলা। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর এখনও পর্যন্ত বিজেপির অপশাসনের বিরুদ্ধে দেশের কোন জায়গায় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি তারা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রবাবু নাইডু, অখিলেশ যাদব, শরদ যাদবরা দেশজুড়ে যে বিরোধী মহাজোট গড়ে তুলতে চাইছেন সে ব্যাপারেও সিপিএম প্রথমে সচেষ্ট ছিল না। ফিলহাল দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিজেপি বিরোধী জোটের নামে আদতে তাদের দলকে একটু প্রাসঙ্গিক করে তুলে কল্কে পেতে চাইছেন। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে তাদের দেখা যায় না। ক্ষমতা থেকে সরার পর বাংলা, ত্রিপুরা, কেরালা সব দুর্গেই এই দলটি থাকে শুধু বিবৃতি আর শাসক দলের বিরুদ্ধে মৌখিক সমালোচনায়, এবারেও তাই ঘটেছে। ক্ষমতায় গেলেই তাদের আসল রূপ দেখা যায়।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সূত্রে এই দলটিকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে এদের যে নৃশংস চেহারা আমি দেখেছি তা চিরকাল আমার মনে থাকবে। নন্দীগ্রামে গুলি চলার দিন ভোর রাতে পৌঁছে গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। প্রতিটা রাস্তায় ছিল সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী ও পেটোয়া পুলিশ। কোন জায়গা দিয়ে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই পরিস্থিতিতে আমি সরকার বাড়ির কাগজের সিপিএম ও বামফ্রন্ট বিট করা সাংবাদিক প্রসূন আচার্য্যর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। প্রসূনের সিপিএম কন্ট্যাক্ট যথেষ্ট ভাল। সেও নানা সূত্রে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে আমাকে ভেতরে ঢোকানোর জন্য কিন্তু না পেরে হাল ছেড়ে দেয়। এবার আমি লুকিয়ে মাঠের ভিতর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করি। কিন্তু যে তেখালি ব্রিজের নাম সেই সময় কাগজে প্রতিদিনই ভেসে উঠছিল সেখানকার সিপিএমের কুখ্যাত আঞ্চলিক নেতা অশোক গুড়িয়া স্থানীয় মহিলাদের দিয়ে আমাকে আটকে দেয়।
এত বিস্তারিত বললাম এই কারণেই যে নাহলে শুধু বিবৃতি, নেতাদের বাতেলা, কথায় কথায় জনগণের ভালমন্দ ভেবে অস্থির হওয়া দিয়ে সিপিএম নামক দলটিকে চেনা যাবে না। ক্ষমতায় থাকলে এরা বাঘ, ক্ষমতা না থাকলে এরা ইঁদুর। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে জরুরি অবস্থা কোন সময়েই এরা লড়াইয়ে ছিলেন না। ইঁদুরের মত গর্তে ঢুকে ছিলেন। যে ন্যানো গাড়িটিকে খোদ কোম্পানিই লাভজনক নয় বলে বাতিল করেছেন এরা এখনও তা বাংলা থেকে চলে যাওয়ার জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছেন। এই গাড়ির জন্যই এরা ছলে বলে কৌশলে কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করেছেন, খুন করেছেন কৃষকদের। অধিকার নিয়ে যখন এরা কথা বলে তখন আমার বমি পায়। আমি নিজে একসময় অতিবাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখনও দেখেছি এই দলটির সঙ্গে আর যাইহোক বিপ্লবের কোন যোগাযোগ নেই। যে কোন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা দখল করা এদের উদ্দেশ্য। ছাত্রযুবদের বিভ্রান্ত করাই এদের কাজ। ঠেকে শিখে তরুণরা এখন আর এদের ছায়া মাড়ায় না। যে কজন ছাত্রযুবদের এদের সঙ্গে দেখি তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়।
শীতঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে একটা মিছিল করেই এরা আবার স্বমূর্তি ধারণ করেছেন। চিত্রসাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, পদযাত্রায় লাভ হয় শুধু চিত্রসাংবাদিকদের। কারণ, ভাল ছবি হয়। ওপর থেকে লাল টুপি, লাল স্কার্ফ, লাল পতাকাধারী এবং লাল ব্যানারধারী মানুষদের ছবি দেখলে বেশ বিপ্লব বিপ্লব মনে হয়। করিৎকর্মা রিপোর্টাররা পেয়ে যান একটা হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরি যার প্রতিটি লাইনে থাকে একজন গরীব মানুষ কত দীর্ঘ পথ হেঁটে নিজের দাবী নিয়ে এই শহরে এসে পৌঁছেছেন সে কথা। কিন্তু পৌঁছনোর পর তার প্রাপ্তিযোগ শূন্য। তার ঝুলিতে তখন শুধুই আশ্বাস এবং সূর্যকান্ত মিশ্র, অমিয় পাত্র, অমল হালদারের মত লোকেদের আস্ফালন কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়া যাবে না। যদি প্রশ্ন করি, ছাড়বেন না তো বোঝা গেল কিন্তু কত ইঞ্চি জমি এখনও পর্যন্ত আপনারা দখল করলেন সেটা বলবেন?
এদের কথা কিছুই বোঝা যায় না। যেমন জানা যায় না যে দলটিকে এরা গোটা দেশের পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ বলে চিহ্নিত করেছেন সেই বিজেপির বিরুদ্ধে কোন জায়গায় তারা কীভাবে লড়ছেন, কী কর্মসূচি নিয়েছেন? ২০১১সালে বাংলায় ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর শাসকদলের সমালোচনা ছাড়া তারা আর কি করেছেন? আদর্শ শূন্য, মাঠে ময়দানে, কলকারখানায় লড়াই করার চেষ্টাটাও শূন্য, কাজ বলতে আছে শুধু দেখে নেব গোছের হুঙ্কার আর অন্যের সমালোচনা। লেনিন, মার্কস সবাইকেই এরা প্রবল দক্ষতায় শুধু কয়েকটা নাম বানিয়ে ছেড়েছেন। আর এদের মুখে সেই নাম শুনলে আশায় বুক বাঁধার বদলে লোকে ভয় পান।
আপনাদের হুঁশ ফিরবে এমন আশা করি না। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে কিছু মানুষ এখনও আপনাদের কথাবার্তা শুনে বিভ্রান্ত হন, ভুল পথে হাঁটেন। আপনাদের বিপ্লবের ডাক সফল হবে কিনা জানিনা। তবে এই জিনিস আরও কিছুদিন চললে সিপিএম নামক দলটির যে গঙ্গাযাত্রা হবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )