গ্রিন করিডোর হয়ে উঠছে লাইফ করিডোর। তা যেন মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছে মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে। কালো মৃত্যু হেরে যাচ্ছে সবুজ জীবনের কাছে। যারা কিছুই হচ্ছে না বলে দিনরাত হাহুতাশ করছেন তারা দেখুন চেষ্টা আর ইচ্ছার সঙ্গে নিখুঁত ব্যবস্থাপনার সমম্বয় হলে দুর্গাপুর থেকে ২ঘন্টারও কম সময়ে চলে আসা যায় ১৭২কিলোমিটার পথ। বেঁচে যায় তিনটে প্রাণ, ফিরে আসে মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতি বিশ্বাস। আজ থেকে বহু বছর আগে আমাদের কলেজে পড়ার সময়ে ছোটখাটো অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ ব্রজ রায়কে দেখতাম জনে জনে মরণোত্তর দেহদানের কথা বোঝাচ্ছেন। অনেকেই গুরুত্ব দিতেন না এমনকি গণমাধ্যমও ব্যাপারটাকে তখন তেমন আমল দিত না। কিন্তু ব্রজদা হাল ছাড়েন নি। এখন মানুষ মরণোত্তর দেহ দানের গুরুত্ব বুঝেছেন, মৃত মানুষের দেহ থেকে জীবিত অসুস্থ মানুষের শরীরে অঙ্গ সংস্থাপন হয়ে উঠছে এক চেনা ঘটনা। দুর্গাপুরের সি আই এফের জওয়ান রমেন্দ্রনাথ মিশ্রদের মত মানুষের মনে ব্রজদার মত মানুষেরাই বুনে দিয়েছিলেন এক সঙ্কল্প। যার জোরে ন-বছর আগে দিদির মৃত্যুর পর তার চক্ষুদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। আর কিছুদিন আগে একই কথা বুঝিয়েছিলেন তার সহকর্মী সি আই এসের জওয়ান দিলীপ বায়েনকে। তার ১৩বছরের মেয়ে মধুস্মিতার মৃত্যুর পর অঙ্গদানে সন্মত হয়েছিলেন দিলীপ। রমেন্দ্রনাথ নিজে তো বটেই তার স্ত্রী ও বড় ছেলে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন।
যতটা চট করে লিখে ফেলছি ব্যাপারটা ঠিক ততটা সহজ নয়, বরং বেশ কঠিন। শোকের সময় নিজেদের পরিজনদের কাছে প্রস্তাবটা পাড়তেও বুকের দম লাগে। অনেক সময় দেহ কিংবা চক্ষুদানের অঙ্গীকার পত্রে সজ্ঞানে, স্বেছায় সই করার পরেও মৃতের প্রিয়জনেরা তার অঙ্গ অন্যের শরীরে সংস্থাপনের অনুমতি দেন না, ভাগিয়ে দেন। অনেক বিখ্যাত মানুষের পরিবারের লোকেরাও তাদের প্রিয়জনের শরীর থেকে অঙ্গীকার পত্র অনুযায়ী অঙ্গ নিতে সন্মতি দেন না। অনেক গালমন্দও সহ্য করতে হয় মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের। কিন্তু রমেন্দ্রনাথের মত মানুষেরা এসব গায়ে না মেখে মৃত্যুর উপত্যকায় জীবনের ফুল ফোটানোর কাজ চালিয়ে যান।
ইচ্ছা ও অঙ্গীকার শুধু কাগজে কলমে বা কথায় থেকে যায় যদি না তার সঙ্গে সঠিক ব্যবস্থাপনা যুক্ত হয়। গ্রিন করিডোর হল সেই ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনা আদতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা সিদ্ধান্তকে সম্ভব করে তুলেছে। ডাক্তাররা বলেন, ব্রেন ডেথে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে অঙ্গ সঠিকভাবে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হলে আট ঘন্টা পর্যন্ত প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয় না। অঙ্গ সংস্থাপনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সাফল্য আদতে এই ব্যবস্থাপনারই সাফল্য। গ্রিন করিডোর হল এই ব্যবস্থাপনার সাফল্যের এক নিদর্শন। তৎপর ও দায়বদ্ধ চিকিৎসক দল, বাড়ির লোকের সহমর্মিতা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং যে সড়কপথ দিয়ে অঙ্গটি রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এসে পৌঁছল তা সবই এক প্রশাসনিক সমন্বয়ের যোগফল। পুলিশের নিখুঁত যান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা, জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ সম্ভব হত না। দুর্গাপুর হাসপাতালে মৃত মধুস্মিতার দুটি কিডনি ও লিভার দমদমের অভিষেক ও নদীয়ার মিঠুনের অঙ্গসংস্থাপন করা যেত না এই সমন্বয় না থাকলে। পশ্চিম ও পূর্ব বর্ধমান, হুগলী ও হাওড়ার চারটি জেলা প্রশাসন ও পুলিশের কাজের সমন্বয়ে ভর সন্ধ্যায় এই সড়কপথে যানবাহনের চাপ ও যানজট সামলে মৃতদেহটিকে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে আনা সম্ভব হল।
যারা সবকিছুতেই বাংলার পিছিয়ে যাওয়া দেখেন, জানিনা এই সাফল্যে তাদের মনোভাব বদলাবে কিনা। তবে মানুষের ভাবনা যে বদলাচ্ছে তা অঙ্গদানের ইচ্ছা বাড়ার সংখ্যা দেখে বোঝা যায়। আগের তুলনায় আরও অনেক বেশি মানুষ মরণোত্তর দেহদান এবং মৃতের প্রিয়জনেরা অন্যের শরীরে সংস্থাপনের সন্মতি দান করছেন। যে ভারতে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান সবকিছুতেই রাজাগজা, ঠাকুরদেবতা, ভুতপ্রেত ইত্যাদি নানা অলৌকিক মহিমায় মুড়ে ফেলা হচ্ছে সেই ভারতেরই বাংলা নামক একটি রাজ্যের মানুষের মধ্যে সুস্থ বিজ্ঞানসম্মত ভাবনার প্রসার দেখে বঙ্গবাসী হিসেবে আমার গর্ব হয়।
গ্রিন করিডোরের ভাবনাটাও বিজ্ঞানসন্মত যান নিয়ন্ত্রণের ভাবনারই একটা ফসল। এর জন্য রাজ্য পুলিশের ব্যবস্থাপনাকে সাধুবাদ দিতেই হবে। গোটা কৃতিত্বটাই তাদের প্রাপ্য, তাদের সহযোগিতা না থাকলে একাজ সফল হত না। পূর্ব বর্ধমান সংলগ্ন ২নম্বর জাতীয় সড়কে এরজন্য দশটা মোবাইল টিমসহ প্রায় ২০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। নানা মোড় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এরফলে অন্য রাস্তা থেকে গাড়ি সেখানে ঢুকতে পারেনি। হুগলীর বিভিন্ন জায়গায় নো এন্ট্রি ছাড়াও অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফাঁকা রাখা হয় ডানকুনি কোল প্লাজার ভিআইপি লেন। যে পুলিশকে কারণে অকারণে নানা দোষ দিয়ে গালাগাল করা হয় তারাই করলেন এই কাজ। পূর্ব ভারতে এই প্রথম এত কম বয়সী কোন ব্রেন ডেথ হওয়া রোগীর অঙ্গদানের ঘটনার সাফল্যে তাদের অবদানকে মনে রাখতে হবে।
যারা শুধুই বলেন সরকারি হাসপাতালে কিছুই হয় না, সেখানে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, তারা জেনে রাখুন এই সফল অঙ্গ সংস্থাপনের বেশিরভাগ ঘটনাগুলোই কিন্তু ঘটছে এসএসকেএম বা মেডিকেল কলেজের মত সরকারি হাসপাতালে। গত শনিবার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সৈকত লাট্টু নামে এক যুবকের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয়েছে রাখাল দাসের শরীরে। চালু ধারণাগুলো এভাবে বদলে গেলে ভালই লাগে। এ ব্যাপারে রাজ্যের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও প্রশংসনীয়। গ্রিন করিডোর দিয়ে অঙ্গ নিয়ে চিকিৎসক দল কলকাতায় পৌঁছনো থেকে শুরু করে অঙ্গ সংস্থাপন, বাড়ির লোকেদের প্রতিক্রিয়া, মানুষের মতামত সবকিছুই তারা সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন। এরফলে অঙ্গ সংস্থাপন সম্পর্কে মানুষ উৎসাহী হবেন। তাদের অনেক ভুল ধারনাও ভাঙবে।
অঙ্গদান নিয়ে মানুষের উৎসাহ ও সচেতনা বাড়ানোর জন্য আমার একটা প্রস্তাব আছে। বাংলায় অঙ্গদানের সাফল্যের প্রথম দিনটাকে অঙ্গদান সচেতনতা দিবস হিসেবে পালন করলে কেমন হয়? এই দিনটায় আমরা সাধারণ মানুষের কাছে অঙ্গদানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবো, চেষ্টা করবো এ ব্যাপারে মানুষের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা গড়ে তোলার। অঙ্গদান নিয়ে অনেক ভুল ধারণার অবসান হবে এরফলে। মানুষ বিশ্বাস করতে শিখবে অঙ্গদান অনেক জীবনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আবার মৃত ব্যক্তির প্রিয়জনেরাও দেখবেন তাদের চলে যাওয়া প্রিয়জনের একটি অঙ্গ বেঁচে রয়েছে এক জীবন্ত মানুষের শরীরে, মৃত্যুকে হারিয়ে দিয়েছে জীবন। মরণোত্তর দেহদান আন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুই শেষ কথা নয়, মানুষের সঙ্কল্প ও ইচ্ছায় অমৃতময় হয়ে উঠছে জীবন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
ছবি সৌজন্য: পার্থ পাল (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)