যে কোন নিরাভরণ ও সহজ সরল ব্যাপারের একটা স্বাভাবিক শক্তি আছে। প্রতিবার চলচ্চিত্র উৎসবের তারকা সমারোহে যেভাবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা ব্যাপারটা পরিচালনা করেন, তা দেখে বারবার আমার এই কথাটাই মনে পড়ে। অমিতাভ-শাহরুখ থেকে সৌমিত্র-প্রসেনজিৎ, জয়া-ওয়াহিদা থেকে ঋতুপর্ণা-নুসরত সবাইকেই তিনি সমান দক্ষতায় সামলান, নিজগুণে আপন করে নেন। নিজে বিরাট ফিল্মবোদ্ধা বলে কোন দাবি তিনি করেন না, তার মুখে কয়েক মিনিট পরপর ডি সিকা, কুরোশাওয়া, বেয়ারম্যান, আন্তোনিওনি, ফেলিনি,গোদার, ত্রুফোর নাম শোনা যায় না। শুধু আন্তরিকতা এবং নতুনভাবে ভাবার স্বপ্ন নিয়ে তিনি যে কোন বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়েন। বাংলা চলচ্চিত্রের ১০০বছরে ২৪তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবেও তার ব্যতিক্রম হল না।
এই সাহস আছে বলেই তিনি এই উৎসবকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে না করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের কাছে পরবর্তীকালে উৎসবকে আরও সুন্দর ও সফল করার ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে পারেন, বলতে পারেন, আমরাও কান-এর মত চলচ্চিত্র উৎসব করতে পারি। বহু বছর ধরে আমি চলচ্চিত্র উৎসব কভার করছি। আমার বলতে দ্বিধা নেই গুণেমানে অংশগ্রহণে গত ৮বছরে এই উৎসবের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। সাহস আছে বলেই তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়েই অমিতাভ-শাহরুখদের মত তারকাদের স্পষ্ট বলে দিতে পারেন, আগামী বছরও আসতে হবে। এখন বাংলার প্রতিটি মেলা, উৎসব, সমারোহের দিকে তাকালেই আমরা দিদির উদ্ভাবনী ভাবনার চিহ্নগুলি স্পষ্ট পড়ে নিতে পারি। চলচ্চিত্র উৎসবেও তিনি সেকথা বারবার প্রমাণ করে চলেছেন।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মানুষের অংশগ্রহণই যে কোন কাজে সাফল্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তিনি ভালোবাসেন বড় করে ভাবতে। এই ইচ্ছার জোরেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই তিনি বলতে পারেন, আগামী বছর সল্টলেক স্টেডিয়ামে এক লাখ মানুষকে নিয়ে কলকাতার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ২৫বছর পালন করার কথা। অনেক সংশয়ী সমালোচক একথা শুনে মুখ বেঁকিয়ে হাসতে পারেন, সে তো নেতাজী ইন্ডোরে চলচ্চিত্র উৎসব করা নিয়েও তারা হেসেছিলেন! কিন্তু সে ঘটনা তো এখন ঘটছে। যারা ভাবতেন চলচ্চিত্র উৎসব শুধুই গুটি কয়েক ফিল্মবোদ্ধার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন একটি ব্যাপার, সাধারণের সেখানে একেবারেই প্রবেশ নিষেধ, তারাই এখন হাঁ করে দেখছেন গত আট বছরে কলকাতার এই ফিল্মোৎসব নন্দন চত্বরের কয়েকশো মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের উৎসবে। প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহ ও প্রদর্শনকেন্দ্র মানুষের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠছে। কোন কাকা, জ্যাঠার গম্ভীর উপদেশ ছাড়াই মানুষ দেশ বিদেশের ছবি দেখে আনন্দে বাড়ি যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রকে সমাজ বদলের মাধ্যম বলে ঘোষণা করা লোকজনেরা কিন্তু একাজটুকু করতে পারেননি। স্বার্থপর দৈত্যের মত আগলে রাখা বামেদের সাংস্কৃতিক বাগানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। দিদি এসে তাকে জনগণের উৎসবে পরিণত করেছেন। কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবের দিকে এখন তাকালেই তা বোঝা যায়।
বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ ও দর্শকদের নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কোন দুশ্চিন্তা নেই। কারণ, তিনি জানেন, ভাল ছবি দর্শকদের বেশি করে হলে টেনে আনতে পারে। বৈচিত্র আনতে হবে তার বিষয় ও নির্মাণ ভাবনায়। নতুন চলচ্চিত্রকারদের উৎসাহ দিতে নানা ধরণের ভাবনাচিন্তাও শুরু হয়েছে। কবে কী করেছি, আগের ছবিগুলি কত ভাল ছিল এজাতীয় হাহুতাশে আটকে না থেকে জোর দিতে হবে বিশ্ববাজারের উপযোগী ভাল ছবি তৈরির ওপর। যা জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখাবে আমাদের। একাজের জন্য চলচ্চিত্র উৎসবের গুরুত্ব ও প্রয়োজন মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন। তাই তিনি উৎসবকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। কলকাতা ছাড়িয়ে চলচ্চিত্র উৎসব এখন শহরের লাগোয়া এলাকাতেও প্রসারিত। সল্টলেক, নিউটাউনেও মানুষ দেখছেন ছবি, দেখছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ভাল ছবির পাশাপাশি উৎসবে দেখানো হচ্ছে নানা বিষয়ের ওপর তথ্যচিত্র ও শর্ট ফিল্ম। অর্থাৎ বিষয়ের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র এসেছে।
রাজনৈতিক ছবি, তথ্যচিত্র, বিজ্ঞাপনী ছবি সব কিছুরই শুরু হয়েছিল এই বাংলায়। বাংলার চলচ্চিত্র প্রতিভারা তো বিশ্বজয়ী। সেই ঐতিহ্য নিয়ে শুধু আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম মার্কা কোন জাবর কাটা নয়, তাকে আত্মস্থ করেই তা আরও প্রসারিত করার লক্ষ্যে এগোতে হবে আমাদের। এখানে দল, মত, গোষ্ঠীগত মাতব্বরির কোন জায়গা নেই। কারণ, শুধুই টাকা, কমিটি কিংবা বড় নাম ঝুলিয়ে ভাল ছবি হয়না। বিদেশে তো বটেই দেশের অন্যান্য প্রান্তের চলচ্চিত্র শিল্প এ সত্যটা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে। আশার কথা আমাদের এখানেও সেই ভাবনার ঢেউ এসে পৌছতে শুরু করেছে। চলচ্চিত্র উৎসব এই ঢেউয়ের পালে সুবাতাস দেবে, আজকের তরুণরা নতুন করে অনুভব করবে ছবির সামর্থ্য ও সম্ভাবনা। শুধু তরুণ কেন কাউকেই দূরে সরিয়ে না রাখা এই উৎসব সব বয়সের চলচ্চিত্রকারদের ভাবনা চিন্তার সলতে গুলোকে আরও উস্কে দিক, তা না হলে তো ভাল ছবি হবে না।
সামান্য এই আলোকচিত্রীর একটা ছোট্ট আশা আছে। ২০১৯এ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের রজতজয়ন্তী বর্ষে আমি এই উৎসবে রাজ্যের নবীন চিত্রপরিচালকদের অনেক বেশি পরীক্ষামূলক ছবি, নতুন ছবি, আমরা যে বিষয় ও দৃষ্টিকোণ নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভাবতেও পারিনা সে বিষয়গুলো নিয়ে ছবি দেখতে চাই। যা খোঁজখবর আমি পাই তাতে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আমাকে নিরাশ হতে হবে না। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে এই উৎসব কোন দলবাজির মঞ্চ নয়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীও এভাবে ভাবেন না। তিনি তার একদা বিরোধী বহু মানুষকে সাদরে এই মঞ্চে ডেকে নিয়েছেন। তারাও এসেছেন এবং তাদের মতামতে সমৃদ্ধ হয়েছি আমরা। এখনও যে সব গুণীজন এই উদ্যোগ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন তাদেরও শুধুই দূর থেকে সমালোচনা না করে এগিয়ে আসা দরকার। এগিয়ে এলেই দেখবেন, কোন সমস্যা নেই। মৃণাল সেন থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ মজুমদারের মত পরিচালকদের আগামী বছর এই মঞ্চে দেখতে পেলে আমার সে আশা পূর্ণ হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বিশ্বাস করেন, উৎসব মানেই উদারতা, তা মোটেই আগের আমলের মত স্বার্থপর দৈত্যের বাগান নয়।