কোনও কোনও রাজনৈতিক দলকে ‘সাইনবোর্ড পার্টি’ নামে খোঁচা দেয় আমবাঙালি। কিন্তু সেই দলের নেতারাই কবুল করছেন, তাঁদের দলের সাইনবোর্ডটাও আর নেই, শুধু লেটারহেডটুকু রয়েছে। সেটাও কতদিন থাকবে সন্দেহ।
রাজ্যের একগুচ্ছ বাম ও সোশ্যালিস্ট মনোভাবাপন্ন দল অবলুপ্তির মুখে এখন শেষ যুদ্ধে নেমেছে। একদা রাজ্য রাজনীতির প্রথম সারিতে থাকা আরসিপিআই, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস, মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, বলশেভিক পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি, ভারতের সাম্যবাদী দল, সিআরএলআই ইত্যাদি অনেক দল কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে।
ইতিহাসের নিরিখে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পরেই তৈরি হয়েছিল রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (আরসিপিআই)। ১৯২৮ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে অংশ নিয়ে দেশে ফিরে ১৯৩৪ সালে এই দল তৈরি করেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অসম, মহারাষ্ট্র, বিহারে এই দলের প্রভাব ছিল। সুধীন কুমার ছিলেন ডাকসাইটে নেতা, যিনি যুক্তফ্রন্ট জমানায় তো বটেই, বামফ্রন্টের জমানাতেও মন্ত্রী ছিলেন। এখনও ভবানীপুরে একটি পুরোনো বহুতলের দোতলায় আরসিপিআই-এর রাজ্য দপ্তর রয়েছে। তবে নিয়মিত খোলা হয় না। ল্যান্ডলাইনও অচল। দলের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক মিহির বায়েনের বক্তব্য, ‘রাজ্য দপ্তরে আমাদের এক কর্মী থাকতেন। তিনি কয়েক বছর হল মারা গিয়েছেন’। এবার দলের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটতে চলেছে।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস (বিবিসি) রাজ্যের রাজনীতিতে প্রথম বড় পালাবদল ঘটিয়েছিল। এই দলের নেত্রী রীতা চৌধুরী সিপিএমের প্রতীক নিয়ে কলকাতার ৪১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে লড়াই করে গত পুর নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেসের নেতা সুনীল চৌধুরী যতদিন বেঁচে ছিলেন, গোলপার্কে তাঁর বাড়ি ছিল এই দলের রাজ্য দপ্তর। সুনীলের প্রয়াণের পর বিবিসি-র কোনও দপ্তর নেই। রীতার কথায়, ‘বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস অনেক দিন রেজিস্টার্ড পার্টি নয়। এই দলের কোনও সদস্য তালিকা নেই। পার্টি অফিস নেই। কাউকে চিঠি লেখার প্রয়োজন হয় না। তাই লেটারহেডও নেই।’ অজয় মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর থেকেই বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু, যদিও বাম জমানার মাঝামাঝি পর্যন্ত সবং থেকে এই দলের বিধায়ক ছিল। যে দল রাজ্যকে মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছে সেই বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস এখন কার্যত হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তির দল।
যুক্তফ্রন্ট ও বামফ্রন্ট জমানার আর এক মন্ত্রী প্রবোধ সিন্হা আবার নিজের দল ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট পার্টি (ডিএসপি) তুলে দিয়ে অনুগামী-সহ শরদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। প্রেসিডেন্স কলেজের প্রাক্তনী প্রবোধ রাজ্যের আবগারি ও পরিষদীয় মন্ত্রী ছিলেন। ডিএসপি উঠে যাওয়ায় আনন্দ পালিত রোডে এই দলের দপ্তরও উঠে গিয়েছে। প্রবোধের কথায়, ‘আমরা কোনও জাতীয় দলের অংশীদার হতে চেয়ে এনসিপিতে যোগদান করেছি। ডিসএপি-র ব্যানারে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছিল না।’ ফিলিপস, ব্রিটানিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ একাধিক শিল্পসংস্থায় একদা ওয়ার্কার্স পার্টির শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। এক সময় হুগলির হরিপাল থেকে এই দলের বিধায়ক থাকলেও গত তিন দশক এই দল নির্বাচনে লড়াই করেনি। ওয়ার্কার্স পার্টির রাজ্য সম্পাদক শৈবাল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘আমাদের কোনও পার্টি অফিস নেই। তাই সাইনবোর্ডও নেই। তবে লেটারহেড রয়েছে। আমার বাড়ি থেকেই দলের কাজকর্ম হয়।’ যুক্তফ্রন্ট আমলে বলশেভিক পার্টির বরদা মুকুটমণি রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। দু’দশক হল কলকাতায় এই দলের কোনও দপ্তর নেই। রাজ্য সম্পাদক প্রবীর ঘোষের কথায়, ‘বামফ্রন্ট আমলে আমরা নির্বাচনে লড়াই করিনি। আমাদের দল রাজ্যে নির্বাচনে লড়াই না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
যুক্তফন্ট ও বামফ্রন্ট জমানায় দাপুটে মন্ত্রী ছিলেন রাম চট্টোপাধ্যায়। মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক এবং রাম চট্টোপাধ্যায় এক সময় সমার্থক ছিল। রাজ্যে অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তর তারকেশ্বরের দাপুটে নেতা রাম চট্টোপাধ্যায়ের হাতেই তৈরি। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খিদিরপুরে মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য দপ্তর বিক্রি করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। প্রাক্তন দমকল মন্ত্রী প্রতীম চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করে ২০১৪ সালে এই দলের নিয়ন্ত্রণ জয়হিন্দ সিংহের হাতে যায়। কলকাতায় এখন রাজ্য দপ্তর তৈরির করার জন্য জায়গায় খুঁজছেন জয়হিন্দ। তাঁর কথায়, ‘সল্টলেকে এফই ব্লকে আমার বাড়ি এখন দলের রাজ্য দপ্তর। পৃথক দপ্তর না থাকলেও আমাদের একজন বিধায়ক রয়েছে।’