এ কোন ‘আচ্ছে দিন’, রাতের চেয়েও অন্ধকার? যেখানে তোয়াক্কা করা হল না মানবাধিকারের, সংবিধানের! নোটবন্দি, ১আধারের মত ইস্যুগুলিতে দেশবাসীকে বারবারই বিপাকে ফেলেছে মোদী সরকার। আর এবার প্রশ্ন উঠে গেল নাগরিকের অধিকার ঘিরেই।
ডিটেনশন শিবির থেকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দুই বাঙালি ‘বন্দি’-কে হাতকড়া পরিয়ে বেঁধে রাখার ছবি সামনে এসেছে আসামে। যা রীতিমত অমানবিক, একজন নাগরিকের অধিকারকে খর্ব করা।
গুয়াহাটির বাসিন্দা প্রৌঢ় কৃষ্ণ সরকারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ২৯ অক্টোবর। কৃষ্ণ জানান, এনআরসি-তে নাম উঠলেও তাঁকে ডি-ভোটার বলে দাগিয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল। আদালতে তোলার পরে কৃষ্ণকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন শিবিরে পাঠানো হয়। পথেই অসুস্থ বোধ করেন তিনি। মির্জার হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁকে গোয়ালপাড়া শিবিরে নিয়ে গেলে ডাক্তারেরা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।
কৃষ্ণের যে ছবিটি সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে গোয়ালপাড়া সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হৃদরোগী তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে।
আর অন্য ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, বঙাইগাঁওয়ের বাসিন্দা রতনচন্দ্র বিশ্বাসকে। রতনের নাম ডি-ভোটারের তালিকায় উঠেছিল দু’বছর আগে। পুলিশ গ্রেফতার করে তাঁকে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন শিবিরে পাঠিয়ে দেয়। সম্প্রতি তাঁর গ্যাস্ট্রিক আলসারের অস্ত্রোপচার হয় গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে। ‘বন্দি’ রতনকে হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালের জানলার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেই ছবিটিই প্রকাশ্যে এসেছে।
তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে গতকাল দু’জনেরই হাতকড়া খোলা হয়েছিল বটে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কেন পুলিশ তাঁদের হাতকড়া পরিয়েছিল, সেই নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। সাধারণত, পলায়ন-প্রবণ বিপজ্জনক আসামির ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতিক্রমে হাতকড়া পরানোর বিধান আছে। এ ছাড়া হাতকড়া না-পরানোর কথাই বলে আদালত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশও তা-ই।
কিন্তু এরপরেও কৃষ্ণ আর রতনের মতো দুজন অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই হাতকড়া পরানো হল কেন? আর সরকারি হাসপাতালই বা তা হতে দিল কেন? এই নিয়ে ইতিমধ্যেই আসামের বিজেপি সরকারকে তুলোধোনা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিরোধীরা।
রতনবাবুর নাম ডি-ভোটার তালিকায় উঠল কেন? রতনবাবুর দাবি, তাঁর ঠাকুরদার নাম ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় ছিল। কিন্তু বাবা বিরাজচন্দ্র বিশ্বাস পদবি বদলিয়ে বিরাজচন্দ্র শীল হয়েছিলেন। কিন্তু তার কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না, রতনের পদবিও বদলানো হয়নি। গোল বেধেছে তার থেকেই। তবে বিরাজচন্দ্র বিশ্বাসের নামে গেরুকাবাড়িতে জমি কেনার দলিল ছিল। রতনবাবু মনে করেছিলেন, ওটাই ভারতীয়ত্বের প্রমাণপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।
মাস কয়েক পরে পুলিশ রতনকে গ্রেফতার করে গোয়ালপাড়া ডিটেনশন শিবিরে ঢুকিয়ে দেয়। আদালতে রতনবাবুর আইনজীবী প্রমাণ করতে পারেননি যে, বিরাজচন্দ্র শীল ও বিরাজচন্দ্র বিশ্বাস একই ব্যক্তি। তবে হাতকড়া কাণ্ডের পর রতনবাবুর মামলাটি হাইকোর্টে লড়বেন বলে এগিয়ে এসেছেন আইনজীবী আমন ওয়াদুদ। কৃষ্ণবাবুর মামলাটি দেখবেন হুসেন আহমেদ মাদানি।
গুয়াহাটি হাসপাতালের সুপার রমেনচন্দ্র তালুকদার বলেন, ‘এই ঘটনাটির কথা জানতাম না। হাতকড়া পরানো বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু এ রাজ্যে হাসপাতাল থেকে বন্দি পালানোর ঘটনা এত বার ঘটেছে যে পুলিশ একটু বেশি সতর্ক থাকে। তাই আমরাও তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করি না।’
পুলিশের বক্তব্য, এক জন কনস্টেবলের পক্ষে দিনরাত বন্দি রোগীর পাশে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই ‘আলগা’ করে হাতকড়া পরানো হয়েছিল।
যদিও পুলিশের এমন অমানবিক কাজের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন সকলেই। শোরগোল পড়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়া। পাশাপাশি, রাজ্যের বিজেপি সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। অনেকেই মনে করছেন, ওই দুইজন আসলে আসাম সরকারের বাঙালি বিদ্বেষেরই শিকার।