অবনীর আর অবনীতে থাকা হল না। জীবশ্রেষ্ঠ বলে বিজ্ঞাপিত মানুষেরা চায়নি সে পৃথিবীতে থাকুক, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্র। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর বনের এই ভয়ঙ্কর সুন্দরকে খুন করার জন্য মহারাষ্ট্রের ইয়াবতমাল জঙ্গলে নেমে পড়েছিল দুপেয়েদের এক বিশাল বাহিনী। ১৫০জনেরও বেশি মানুষের সেই বিশাল দলে কী ছিল না? বনকর্মী, বিশেষজ্ঞ, পুলিশ কুকুর, হাতি, নাইটভিশন ড্রোন, ট্র্যাপ ক্যামেরা, ট্র্যাকার, হ্যাং গ্লাইডার এবং নৈবদ্যের ওপর চূড়া সন্দেশের মত শার্প শুটার সবই! এই অসম যুদ্ধের পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। যুদ্ধে হেরে অবনীকে ইয়াবতমাল জঙ্গলে তার দশমাসের দুই শাবককে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের বনদপ্তর ও আদালত এই মৃত্যুতে খুশি হলেও গোটা দেশজুড়ে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বন্যপ্রাণ ভালবাসা সাধারণ মানুষ অবনীকে খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনলাইনে এর প্রতিবাদে চলছে সই সংগ্রহ। কিন্তু এসব কোন কিছুই দুই ব্যাঘ্র শাবকের মাকে ফেরাতে পারবে না। সেই কবে জিম করবেট লিখে গিয়েছিলেন, বাঘ মোটেই নিষ্ঠুর ও রক্তলোভী নয়। পরিস্থিতি তাকে হিংস্র হতে বাধ্য করে কিন্তু আমরা মানুষরা সে কথা মানতে পারলাম কই? একথা ঠিকই দীর্ঘদিন ধরেই বাঘিনীটি মহারাষ্ট্রের পান্ধেওয়াড়া জেলা সংলগ্ন জঙ্গলে ক্ষিদের জ্বালায় মানুষের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩জন মানুষ।
সামান্য সাংবাদিকতার সূত্রে দেশের বিভিন্ন জঙ্গলে আমি পাগলা হাতি থেকে শুরু করে হিংস্র বাঘকে বাগে আনার বহু অভিযানে অংশ নিয়েছি। আমার প্রশ্ন, বাঘিনীটিকে হত্যা করা ছাড়া এই সমস্যা সমাধানের অন্য কোন পন্থা কি ছিল না? বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে নিশ্চয়ই ছিল কিন্তু সহজ সমাধানের রাস্তায় বিশ্বাসী বনদপ্তরের একশ্রেণীর আমলা এবং বাঘিনীটিকে মারতে যে শার্প শুটারদের নিয়োগ করা হয়েছিল তারা এটা বোঝেন নি। তাই পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে অবনীর মৃত্যুতে তার শাবক দুটি তো বটেই, গোটা এলাকায় বাঘের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হবে। কারণ, গোটা জঙ্গলে এখন শুধু একটিই পুরুষ বাঘ রয়েছে। অবনী থাকতো কিন্তু টিপেশ্বর নামে একটি ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রে, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। মানুষ তার প্রয়োজনে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকেছে বাঘ কিন্তু মানুষের এলাকায় ঢুকতে যায় নি। গ্রামবাসীদের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করতে হবে কিন্তু তা বলে বাঘকে মারতে হবে কেন?
প্রশ্ন উঠেছে এই অভিযানে সরকার নিযুক্ত শার্প শুটার আসগর আলি খানের ভূমিকা নিয়েও। হায়দরাবাদের নবাব পরিবারের ছেলে এই আসগর আলি। তার বাবা নবাব শাফাত আলি খানও ছিলেন সরকার নিযুক্ত শিকারি। বাঘ মারার ঐতিহ্য এই পরিবারে প্রাচীন। শাফাতের বিরুদ্ধেও আগে বেশ কয়েকবার স্রেফ ট্রোফি জেতার জন্য বাঘ মারার অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ রয়েছে আসগর আলির বিরুদ্ধেও। নিজের অভিজ্ঞতায় আমিও সরকার নিযুক্ত বেশ কিছু শিকারির মধ্যে এই খুনে মানসিকতা দেখেছি। সুব্রত পাল চৌধুরীর মত কয়েকজন দায়িত্ববান বিশেষজ্ঞদের বাদ দিলে এ ধরণের অভিযানে অংশ নেওয়া মানুষদের অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাণীটিকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবতে পারেন না। যদিও কাগজে দেখলাম বাঘিনীটিকে মারার পর আসগর বলেছেন, অন্ধকার রাতে বাধ্য হয়েই তাকে বুলেট ব্যবহার করতে হয়েছে। রাজ্য বনদপ্তর সূত্রে জানলাম, এই শাফাত ও আসগর আলি খানরা বাংলায়ও বনদপ্তরের অনেক অভিযানে অংশ নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাদের ট্র্যাক রেকর্ড দেখে রাজ্য সরকার তাদের সেই অনুমতি দেননি।
গোটা অভিযানটির সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে। এক, দলটির সঙ্গে সরকার নিযুক্ত কোন পশু চিকিৎসক ছিলেন না অথচ তারা ছাড়া এই ধরণের অভিযান করাই যায় না। আমারও প্রশ্ন, যে অভিযানে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ঘুমপাড়ানি গুলি ব্যবহার করাই নিয়ম সেখানে তিনি বুলেট ব্যবহার করলেন কেন? দুই, আমেরিকান সুগন্ধ ও অন্য বাঘিনীর মূত্র ছড়িয়ে পরিকল্পিত উপায়ে বাঘিনীটিকে অনুসন্ধানকারী দলটির কাছে টেনে আনা হয়েছিল বলে আমরা জেনেছি। সঙ্গে ছিল নাইটভিশন ক্যামেরাও। তাহলে বাঘিনীর শরীরে বুলেট চালানোর আগে ঘুমপাড়ানি গুলি চালানোর অসুবিধা ছিল কোথায়? তিন, বাঘিনীটি উৎপাত চালাচ্ছিল গত দুবছর ধরে। এই এলাকায় ২০০জন বনকর্মী থাকা সত্বেও দুবছরে সংশ্লিষ্ট বনকর্তারা তাকে পাকড়াও করার কোন কৌশল বার করতে পারলেন না কেন? বিশেষ করে তারা যখন বুঝতে পারছিলেন এই কাজটি বাঘিনীটিই করছে? অভিযানের ধরণ দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে আয়োজনের কোন ঘাটতি ছিল না। চার, ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাঘিনীর দেহে ঘুমপাড়ানি গুলির ডার্ট বিঁধে আছে আবার আসগর বলছেন, এই গুলি ব্যবহার করা সম্ভব হয় নি, কোনটা সত্যি? পাঁচ, ছবিটি দেখার পর আজকে সকালে আমি কয়েকজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অভিমত ম্যাগনিফাইং গ্লাসে দেখা যাচ্ছে ঘুমপাড়ানি গুলির সঙ্গে দেওয়া ওষুধ শরীরের ভেতরে ঢোকেনি। তাছাড়া শরীরে কোন গুলি ঢুকলে যে রক্তপাত হয় সেটাও বাঘিনীর শরীরে ছিল না। অনেকে বলছেন, বাঘিনীর মৃত্যুর পর ওই ডার্টটা তার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। যাইহোক ব্যালাস্টিক পরীক্ষার রিপোর্টই এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
প্রয়োজন বড় বালাই, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বন্যপ্রাণ ভালবাসা মানুষদের প্রতিবাদের মধ্যেই ইয়াবতমাল অরণ্য সংলগ্ন এলাকায় মানুষরা পালন করছেন বাঘিনী বিনাশ উপলক্ষে উৎসব। এমন আশ্চর্য বৈপরীত্য এই আজব দেশেই সম্ভব। বোঝা যাচ্ছে মানুষকে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ করতে পারিনি আমরা। এখনও সংরক্ষিত এলাকায় অবাধে ঢুকছে মানুষ আবার এই সমস্যার মোকাবিলায় বন্যপ্রাণ নিধন ছাড়া অন্যকিছু ভাবার মানসিকতা তৈরি হয়নি খোদ বনকর্তাদের মধ্যেই। এই সাঁড়াশি আক্রমণে অবনীদের মৃত্যু কিংবা অনাহার এদুয়ের মধ্যে কোন একটি বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অবনী বাড়ি আছো বলে তাদের ভালবেসে ডাকার লোকও এখন অনেক কম।
https://www.facebook.com/ekhonkhobor18/videos/324003201529117/?t=4
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )