ভোটের রাজ্যে বিজেপি বর্ণময়! তাদের ঝান্ডার রঙ যতই গেরুয়া হোক, বিপাকে পড়লেই রঙ বদলাতে ওস্তাদ তারা।
সত্যিই ভোট বড় বালাই। জীবদ্দশাতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে যারা দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছিল, আজ তারাই তাঁর মতো দেশপ্রেমিক হয় না বলে কুন্তীরাশ্রু ঝরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী মাথায় আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপি পরে লালকেল্লায় গিয়ে নেতাজির মতো দেশপ্রেমিক হয় না ধরনের বক্তব্য রেখে বাজারে সাড়া ফেলে দিয়েছেন ৷ প্রধানমন্ত্রী বলছেন বলে কথা। তাঁর বক্তব্য, একটা মাত্র পরিবারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং বি আর আন্বেদকরের মতো ব্যক্তিত্বদেরকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল । যদিও ইতিহাস বলছে অন্য তথ্য ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভাবধারা যে আরএসএস বা রাষ্টীয় স্বয়ংসেবক সংঘের থেকে লিখেছিলেন, সেই আরএসএসই ১৯৪৫ সালে রীতিমতো কার্টুন এঁকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, মহাত্মা গান্ধির মতো দেশ নেতাদের রাবণ সাজিয়ে রাবণ-দহন বা দশেরা পালন করতে চেয়েছিল ৷ মহাত্মা গান্ধির হত্যাকারী নাথুরাম গডসের মতো কট্টর আরএসএস নেতা তাঁর নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘ অগ্রণী’তে এই কার্টুন প্রকাশ করেন ৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে রামের পরিবর্তে আরএসএসের দুই তিরন্দাজ উদ্যত হয়েছে দশমাথা রাবণকে জ্বালাতে ৷ সেই তিরে লেখা রয়েছে ‘অখণ্ড ভারত’ ৷ রাবণের প্রধান মুখ যেখানে মহাত্মা গান্ধির, সেখানে পরের মুখগুলি বানানো হয়েছে সর্দার বল্লভভইি প্যাটেল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের মতো নেতাদের মুখের আদলে ৷ সেই নাথুরাম গডসে’র মূর্তি বানিয়ে মোদীর আমলে দেশে রীতিমতো মন্দির বানিয়ে পুজাে করেন আরএসএস এবং বিজেপি নেতারা ৷ এখন আজীবন রাষ্টীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ছত্রছায়ায় বড় হওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী যখন শুধুমাত্র ৫ রাজ্যে বিধানসভা ভোট এবং সামনেই লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশে নেতাজি তাস খেলার জন্যে জোর গলায় লালকেল্লার সরকারি অনুষ্ঠান থেকে দাবি করছেন, কংগ্রেস এবং গান্ধি পরিবার নেহরুকে বড় করে দেখানোর জন্যে নেতাজি-প্যাটেলদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল ৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা এবং গুরুত্ব পাননি তাঁরা । যদিও প্রধানমন্ত্রী এদিন লালকেল্লায় সরকারি অনুষ্ঠানের আড়ালে কার্যত রাজনৈতিক প্রচার করছেন বলে সরব হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসও । কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র তথা বাংলা থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ অভিষেক মনু সিংভি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে কার্যত মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী একজন আরএসএস নেতার নাম করুন যিনি নেতাজি বা বল্লভভাই প্যাটেল এর সেই সময়ে দেশপ্রেমিক বলে স্বীকার করেছিলেন। বরং জওহরলাল নেহরু নিজে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে মামলায় আদালতে নেতাজির হয়ে মামলা লড়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সত্যি কথা বললে তার প্রমাণ দিন। ১৯৪৫ সালে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের কিছুদিন আগে প্রকাশিত নাথুরাম গডসের এই পত্রিকাতে যেখানে নেতাজিকে হত্যা করলে বা পুড়িয়ে ফেললে তবেই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা পাবে বলে আরএসএস মনে করছে, সেখানে আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর পূর্তির দিনে দাঁড়িয়ে আজীবন আরএসএস মোদীর দাবি তিনি নাকি নেতাজির দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সেই।
এখন মােদি’র উপলব্ধি নেতাজি দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্যে অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন। তা আমাদের সরকার ও এই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নের দিকে জোর দিয়েছে। যদিও নিন্দুকেরা বলতে শুরু করেছে, সামনে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানকার মানুষের জন্যে ঘুরিয়ে নির্বাচনী প্রচার ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। তার ওপরে বড়জোর মাস তিনেকের মধ্যে হয়ে ঘোষণা হয়ে যাবে লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ। বাংলায় বিজেপি কোনো সুবিধা করতে পারবে না বুঝতে পেরে হয়ে বাঙালির চিরন্তন সেন্টিমেন্ট নেতাজিকে নিয়ে নিয়ে হালকা একটু সুড়সুড়ি দেওয়া আর-কি। অবশ্য সিপিএম-ও তার এককালে নেতাজিকে ‘তেজোর কুকুর’ বলে প্রচার করে। তারাও এখন ভোট এলেই নেতাকে মাথায় তুলে নাচা নাচি শুরু করে দেয়। সত্যিই ভােট বড় বালাই।
( সংগৃহীত )