ভোট যত এগিয়ে আসছে ততোই মরিয়া হয়ে উঠছে বিজেপি সরকার। যে ইস্যুগুলিকে ব্যবহার করে ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানো যায়, সেই ইস্যুগুলিকেই হাতিয়ার করতে চায় তারা। এবার তাদের পাখির চোখ স্বয়ং নেতাজি। রাজনৈতিক স্বার্থে এর আগে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামও বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে নির্বাচনী প্রচারে।
রবিবার নাম না করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নেতাজিকে অবমাননার অভিযোগ তুললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেহরু-গান্ধী পরিবারের গৌরবগাথা প্রচার করতে গিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে কংগ্রেস। একইসঙ্গে তাঁর অভিযোগ, ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সর্দার প্যাটেল, বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো নেতাদের অবদানও।
৭৫ বছর আগে ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন নেতাজি। সেই দিনটিকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে, রবিবার লালকেল্লায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল মোদী সরকার। যেখানে আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপি মাথায় দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মোদী। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হয়েছেন তিনি।
মোদীর তোলা অভিযোগের কড়া জবাব দিয়েছে কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি বলেছেন, ‘নেতাজির ঐতিহ্য আত্মসাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি আরও বলেন, ‘বিজেপি দেশের ইতিহাস নতুন করে লেখার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য তারা সর্দার প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু এবং নেতাজি সুভাষচ্ন্দ্র বসুর মধ্যে একটা কাল্পনিক বিভাজন তৈরি করতে চাইছে। সস্তা রাজনৈতিক চাল সফল করতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এ ধরনের পবিত্র অনুষ্ঠানগুলি ব্যবহার করছে।’
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে লেখা সর্দার প্যাটেলের চিঠি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘চিঠিতে প্যাটেল লিখেছিলেন, সরকারের অস্তিত্বের পক্ষে হিন্দু মহাসভার কাজকর্ম ভীতির কারণ।নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও ওই সংগঠনের কাজকর্ম বন্ধ হয়নি।’ সিংভি আরও অভিযোগ করেন, ‘আরএসএসের গুরু তথা হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে লোকেদের যোগ দেওয়াতে প্রচার করেছিলেন। দেশ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর লক্ষ্যকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ মনে করতেন আরএসএস নেতা গোলওয়ালকার। অথচ আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বিচারের সময় নেতাজির অন্যতম আইনজীবী ছিলেন নেহরু। আরএসএসের কেউ তখন নেতাজির সমর্থনে দাঁড়াননি।’
বিতর্কে স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ নেতাজি পরিবারের সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু বলেছেন, ‘দেশের জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে কে বড় কে ছোট, কার ভূমিকা কতটা, এসব নিয়ে যে কোনও রকম আলোচনাই এখন অর্থহীন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সমস্ত রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।’
আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এদিন টুইট করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রেড রোডে আইএনএ স্মারকের সামনে গান স্যালুটে শ্রদ্ধা নিবেদন করে রাজ্য সরকার। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়। ‘জয়হিন্দ দেশপ্রেমী মঞ্চ’ও স্মারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
প্রসঙ্গত, নেতাজি সম্পর্কে সব তথ্য প্রকাশ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মমতা। ২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নেতাজি সংক্রান্ত গোপন তথ্য সম্বলিত ৬৪টি ফাইল সাধারণের জন্য প্রকাশ করেন তিনি। ফাইলগুলিতে মোট ১২ হাজার পৃষ্ঠা রয়েছে। ওইসব ফাইলে উল্লেখ আছে, নেতাজির ঘনিষ্ঠ সঙ্গী দেবনাথ দাস দাবি করেছেন ১৯৪৮ সালে নেতাজি ছিলেন চিনের মাঞ্চুরিয়া এলাকায়। তবে নেতাজিকে নিয়ে মোদীর মত নোংরা রাজনীতি করার কোনও চেষ্টা মমতা করেননি।
যে রাজনৈতিক দল মূলত নেতাজির আদর্শে উদ্বুদ্ধ, সেই ফরওয়ার্ড ব্লকও কড়া নিন্দা করেছেন বিজেপির। আইএনএ স্মারক এবং নেতাজি মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করার পর দলের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি বলেন, ‘সুভাষচন্দ্র বসুকে হাতিয়ার করে ভোটের রাজনীতি করছে বিজেপি। এখন সামনে নির্বাচন। মূল্যবৃদ্ধি চরমে। বাড়ছে দারিদ্র আর বেকারত্ব। সেদিক থেকে নজর ঘোরাতেই বিজেপি নেতাজিকে আঁকড়ে ধরছে।’
পাশাপাশি তাঁর অভিযোগ, স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করার পর নেতাজি আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপের নামকরণ করেছিলেন যথাক্রমে ‘শহিদ’ এবং ‘স্বরাজ’। কিন্তু সেখানে বিজেপি সরকার এখন সাভারকারকে নিয়ে মাতামাতি করছে। তারাই আসলে ভুলে গেছেন নেতাজির মহিমা।
বস্তুত, কেন্দ্রীয় সরকার যে সময়ে বর্ষপূর্তির এই কর্মসূচির আয়োজন করেছে, তখন দেশে বিভিন্ন সমস্যা ক্রমবর্ধমান। রাফাল প্রশ্নে মোদীকে লাগাতার আক্রমণ করছেন বিরোধীরা। পাশাপাশি পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি–সহ বিভিন্ন বিষয়ে মোদি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার মমতাও। তাই তাঁর ‘আচ্ছে দিন’ ফুরিয়ে যাচ্ছে দেখেই নেতাজিকে ‘ব্যবহার’ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মোদী।