‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ নিয়ে রাজ্য সরকার ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাইকে বিপজ্জনক স্টান্টবাজি নিয়ে পুলিশও বারবার সতর্ক করেছে। তবে এতকিছুতেও যে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি, তা ফের প্রমাণ হল শনিবার সাতসকালেই।
গতকাল সকাল সাতটা নাগাদ দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে বাইক নিয়ে স্টান্টবাজি দেখাতে গিয়ে মৃত্যু হল এক কিশোরের। জানা গেছে, মৃতের নাম লালু সাহানি ওরফে স্যামুয়েল (১৭)। বাড়ি ভবানীপুর। কলকাতার একটি নামী স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল সে। শনিবার সকালে গাড়ির চাপ কম থাকায় হুগলি সেতু ফাঁকাই ছিল প্রায়। সেই সুযোগেই ওই কিশোর স্টান্টবাজি দেখাচ্ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেতুর উপরে উঠে ওই কিশোর হাত ছেড়ে বাইক চালাচ্ছিল। তার বাইকের পিছনে অন্য এক কিশোরও ছিল। দ্রুত গতিতে হাওড়ার দিক থেকে কলকাতার দিকে বাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় আচমকাই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে সেতুর ধারের ডিভাইডারে ধাক্কা মারে।
পুলিশ সূত্রে খবর, দু’জনের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। ডিভাইডারে ধাক্কা লাগার পর দু’জনেই রাস্তায় ছিটকে পড়ে। সেতুর উপরে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের উদ্ধার করে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই স্যামুয়েলকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। তবে তার বন্ধুর শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মৃতের পরিবার সূত্রে পুলিশ জানতে পেরেছে, গতকাল সকালে কাউকে কিছু না জানিয়েই দাদার বাইক নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছিল স্যামুয়েল। প্রথমে তারা প্রিন্সেপ ঘাটে যায়। সেখান থেকে দু’জনে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে ওপারে চলে যায়। সেখান থেকে ফেরার পথেই ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
কী ভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তা জানতে ওই এলাকার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই পুলিশ দ্বিতীয় বাইকে আরোহী কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, দুই বন্ধু মাঝেমধ্যেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। পুজোর সময়েও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে।
এছাড়া মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এক দমকল কর্মীরও। শুক্রবার ভোরে সি আর অ্যাভেনিউয়ের দমকল কেন্দ্রের সামনে একটি অ্যাপ নির্ভর ট্যাক্সির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে সঞ্জয় কুমার সিং (৩৪) নামে ওই দমকল কর্মীর। দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতভর কাজ শেষের পর ওই কর্মী বাইকে করে উত্তরপাড়ায় বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় ক্যাবটি তাঁকে ধাক্কা মারে। হেলমেট না থাকায় তাঁর মাথায় আঘাত লাগে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে জানান চিকিৎসকরা।
তবে পুজোর সময় শহরের রাস্তায় বেপরোয়া বাইকের দাপট বজায় থাকল। হেলমেট ছাড়াই কোনওটিতে তিনজন, কোনওটিতে আবার চারজনকে নিয়ে দ্রুত গতিতে বাইক চলেছে। মধ্যরাতের ইএম বাইপাসের উপরে দেখা গেল বাইক রেসও। অষ্টমী থেকে নবমী, বেপরোয়া বাইকের দাপট এবং একের পর এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
অষ্টমীতে রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ দ্বিতীয় হুগলি সেতু হয়ে হাওড়ার দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসছিল একটি মোটরবাইক। এজেসি বোস রোডে একটি বাঁকের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিনি বোঝাই একটি মিনি ট্রাকে ধাক্কা দেয় মোটরবাইকটি। ধাক্কা মারার পরেই মোটরবাইকের হেলমেটহীন থাকা দুই আরোহী সামনের দিকে ছিটকে পড়েন।
পুলিশ জানিয়েছে, মিনি ট্রাকের চালক ওই দুই যুবককে বাঁচানোর জন্য ব্রেক কষেন। তাতে মিনি ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে বাঁ দিকে মোটরবাইকের উপরেই উল্টে পড়ে। মিনি ট্রাকে থাকা চিনির বস্তায় চাপা পড়েন মোটরবাইক চালক প্রতীম কুণ্ডু (২১) এবং শুভদীপ চক্রবর্তী (২২)। আশঙ্কাজনক অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা দু’জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত দু’জনই নাকতলার বাসিন্দা।
আবার ওই ঘটনার কিছু আগেই শেক্সপিয়র সরণী থানা এলাকার জওহরলাল নেহরু রোড এবং হো চি মিন সরণীর সংযোগস্থলে মোটরবাইকের বলি হয়েছেন রাহুল যাদব (২৪) নামে এক যুবক। জখম হয়েছেন তাঁর বন্ধু সুজয় পাত্রও। তিনি এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। দু’জনেই বালিগঞ্জের ডোভার টেরেসের বাসিন্দা।
জানা গেছে, রাত আড়াইটে নাগাদ দুই বন্ধুকে নিয়ে দ্রুতি গতিতে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন রাহুল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টাটা সেন্টারের কাছে উল্টো দিক থেকে আসা একটি গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় রাহুলদের মোটরবাইকের। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাহুলের। সুজয় এবং অপর দুই বন্ধুকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন, ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর প্রচারে বছরভর পুলিশ অনেকটাই সাফল্য পেয়েছে। পুজোতেও কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছিল। কিন্তু পুজোর ভিড় সামলাতে ব্যস্ত রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। অতিরিক্ত পুলিশবাহিনীও পথে নামানো হয়েছে। তাই তুলনামূলক ফাঁকা জায়গাগুলিতে তেমন নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবু শহরের বিভিন্ন এলাকায় মোটরবাইকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাইক ধরলেই সব কাগজ দেখতে চাওয়া হচ্ছে। না দিতে পারলে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।