অপরূপ দৃশ্য। অদ্ভুত মায়াময়। স্বর্গীয়। আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠছিল আপনার সবুজ রঙের মখমলে মোড়ানো কফিনটা। আর সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে দুটো ফুলের গিটার। শহিদ মিনারে হাজারো মানুষের ভিড় এর আগেও দেখেছি। দেখেছি চলে যেতে, না বলে। কিন্তু শেষ শ্রদ্ধা আর ভালবাসার নিদর্শন যে একটা সৌরভ ছড়ানো ফুলের গিটার দিয়ে হতে পারে, এটা দেখিনি। এটা মরেও দেখিয়ে গেলেন আমাদের এবি। আইয়ুব বাচ্চু। শহিদ মিনার থেকে জাতীয় ইদগাহ ময়দানে ঢুকছি। ঢোকার মুখেই কানে একটা বাক্য ভেসে এল। এক তরুণ আরেক তরুণকে বলছে, ‘এই, এইখানে কি কোনও গানের অনুষ্ঠান হইতাছে?’ এর পর সে মিলিয়ে গেল অজস্র মানুষের ভিড়ে। এটাই আইয়ুব বাচ্চু। আপনার সঙ্গে ‘মৃত্যু’ কথাটা যায় না বাচ্চুভাই। আপনার নাম এলে এমনই এক ছবি চোখের সামনে ভাসে, যার সঙ্গে মৃত্যুর কোনও সংযোগ নেই।
হাজারো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে ছবির মতো। কত প্রেম। কত কলহ। কত মান-অভিমান। কত দূরে সরে যাওয়া। কত কাছে আসা। আপনি এর আগেও এভাবেই এক সকালে স্কোয়্যার হাসপাতালে গিয়েছিলেন। আমার কাছে উপর্যুপরি ফোন কল আসছিল— ‘সাজ্জাদ, কী শুনতেছি? বাচ্চুভাই নাকি মারা গেছেন?’ আমি বিশ্বাস করিনি। আমার বিশ্বাস সত্যি করে দিয়ে আপনি ফিরে এসেছিলেন। আমার লেখা গানে সুর দিয়েছেন। কণ্ঠ লাগিয়েছেন। ফিরে আসার পর প্রথম গানটার কথা এই যে লিখছি, আমি দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ আমার মাথায় এল একটা লাইন— ‘রাখে আল্লা মারে কে?’ লিখে ফেললাম— ‘রাখে আল্লা মারে কে? তোমাদের ভালবাসা ফিরিয়ে এনেছে এই আমাকে, এই আমাকে…।’
গানটা লেখার পর থেকে প্রচণ্ড এক অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। এই গানটা কি বাচ্চুভাইকে দেওয়া ঠিক হবে? উনি কীভাবে নেবেন? পরে ভাবলাম, এই গানটা উনার। এই সত্যিটা আমাকে ফেস করতেই হবে। চলে গেলাম স্টুডিওতে। গিয়ে দেখি, দিব্যি জলজ্যান্ত সেই গিটারের জাদুকর আমার সামনে বসা। কথা না বাড়িয়ে গানটা বের করে দিলাম খাম থেকে। বাচ্চুভাই পড়লেন। পড়তে পড়তেই চোখেমুখে একটা আলোর রেখা দেখলাম। ছোট্ট দুটি কথা। ‘আরে, এটা তো আমারই কথা! তুই কী করে জানলি?’ আমি উত্তরে হেসেছিলাম। বাচ্চুভাই সঙ্গে সঙ্গে পাশের গিটার স্ট্যান্ড থেকে কালো গিটারটা নিয়ে গুনগুন করলেন কয়েক সেকেন্ড। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সুর বাঁধলেন— ‘রাখে আল্লা মারে কে?’ এর পর ঠিক পরের শো থেকেই উনি স্টেজে উঠেই শো ওপেন করতেন এই গানটা দিয়ে। আমায় একদিন বললেন, ‘সাজ্জাদ, তোর ‘রাখে আল্লা মারে কে’ তো হিট। আমি গাইলে সবাই গায়।’ মাঝে মাঝে বলতেন, ‘এই গানটা রেকর্ড করব না। মঞ্চে গেয়ে-গেয়েই মানুষের কাছে পৌঁছে দেব।’
কিন্তু এবারে কেন আর নতুন গান লেখার সুযোগটা করে দিলেন না, বাচ্চুভাই? শেষ গান লিখেছিলাম ‘যদি হারিয়ে যাই এবারের শীতে, তুমি রেখে যেও অশ্রুনদী আমার সমাধিতে/তোমার কান্না ছুঁয়ে শ্রাবণের মেঘ ঝরাব, শরতের রাতে জোছনা ধুয়ে কাজলের মেঘ সরাব…’। গানটার শিরোনাম ‘যদি হারিয়ে যাই’। যদিটাই সত্যি হল, বস। তখনও ভাবিনি কী লিখছি। একটা টিভি প্রোগ্রামের জন্য স্টুডিওতে বসে গিটার নিয়ে টিউনটা শোনালেন। আমি রেকর্ড করে নিলাম। বাসায় ফিরে কখন কী লিখেছি, মনে নেই। কিন্তু সেটাও বিদায়ের গান। অভিমানের গান। ইদানীং ভীষণ তাড়া দিচ্ছিলেন, আপনাকে নিয়ে একটা বই করার। দেখা হলেই— ‘সাজ্জাদ, বইটা কবে করবি? চল নেপাল যাই। একটা স্পনসর জোগাড় কর।’
অঞ্জন দত্তর বইটা সেধে সেধে চেয়ে নিলেন। বইটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি তিনদিনের জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। এই বইটা সঙ্গে নিয়ে যাব।’ ফিরে এসে বললেন, ‘সুপার, সাজ্জাদ। আমি বইটা দুইবার পড়ে ফেলেছি।’ ‘আমার আমি’ প্রোগ্রামটার রেকর্ডিংয়ে আফজাল-ভাইকে বলছিলেন বইটার কথা— ‘সাজ্জাদ আমাকে নিয়ে একটা অটোবায়োগ্রাফি করছে।’ আমি পেছাচ্ছিলাম। বলছিলাম, ‘শীতটা আসুক। তখন আমরা কোথাও যাব। দু’তিনদিন থেকে পুরো বইটা কমপ্লিট করব।’ কোনও এক অভিমানে আমি ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না। বইটা করব কি করব না, সংশয় ছিল। আবার ‘অঞ্জনযাত্রা’ লিখে একটু ক্লান্ত ছিলাম। আবার অন্য একটা ভাবনায় ডুব দিয়েছি। সেটা থেকেও বেরোতে পারছিলাম না। কিন্তু আন্দাজ করতে পারিনি সত্যি সত্যি বস, আপনার কীসের এত তাড়া?
শেষ একদিন স্টুডিওতে গেলাম। সেইদিন বাবাকে নিয়ে কষ্টের কথা বলছিলেন। একা হয়ে যাওয়ার গল্প বলছিলেন, এই বয়েসে এসে। কিন্তু জানেন, সত্যি ভাবিনি এবারের শীত আসার আগেই আপনি চলে যাবেন। আপনার মৃত্যু আমায় নতুন একটা দর্শন শিখিয়ে দিল। আপনার প্রতি যত অভিমান, অভিযোগ, মন্দলাগা— সব কিছুকে একটা সুন্দর নন্দিত প্ল্যাটফর্মে এনে দিল। মৃত্যু যে কত সুশোভিত আর লাবণ্যময়, আমি টের পেলাম। মৃত্যু এক উদ্যান। ক্ষমার। ক্ষমতার। মমতার। মৃত্যুর ভয়ঙ্কর এক সক্ষমতা। আপনি চলে যাচ্ছেন, উড়ে যাচ্ছেন পাখি হয়ে। ডানা মেলে। আমি টের পাচ্ছি। আমি আপনার বিশালতায় ডুবে যাচ্ছি। একাত্ম হয়ে চলেছি একটু একটু করে।
আপনি প্রশ্ন করেছিলেন না-কথা প্রসঙ্গে— ‘আচ্ছা, বইটার নাম কী হবে?’ বইয়ের নাম দিলাম ‘ফুলের গিটার’।
(লেখক আইয়ুব বাচ্চুর গানের গীতিকার ও বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যিক। সৌজন্য: দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ)