‘কন্ঠী’ শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলায় দেখা পাড়ার মাচা অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন হাতে কয়েকটি মুখ। সরস্বতী পুজো বা দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে হওয়া সেইসব মাচায় বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের গান গেয়ে গোটা পাড়া মাতিয়ে রাখতেন ‘আশা’, ‘লতা’, ‘কিশোর’, ‘রফি’-দের কন্ঠীরা। এবার তেমন এক কন্ঠীকে নিয়েই তাঁর ছবির গল্প ফেঁদেছেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। বেশ কয়েকবছর ধরেই সমাজে অপমানিত, অবহেলিত কিংবা প্রচারের আলোয় না থাকা শিল্পীদের নিয়ে কাজ করাটাকে নিজের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছেন কৌশিক। তাতেই নতুন সংযোজন ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’।
রজত ঘোষ গড়িয়ার বাসিন্দা। তবে ছোটবেলায় একবার মঞ্চে কিশোরের গান গাইতে উঠে স্বয়ং গায়কের বাহবা কুড়িয়েছিলেন তিনি। এবং সেই সময়ই কিশোর কুমার তাঁর নাম দেন কিশোর কুমার জুনিয়র। তারপর বয়সের হিসেবে ‘জুনিয়র’ থেকে সিনিয়ার হয়ে গেলেও, ওই নামেই সীলমোহর পড়ে যায়। কিশোর কুমারই হয়ে ওঠেন তাঁর ঈশ্বর, তাঁর ধর্ম। নিজের জীবনে মেনে চলতে শুরু করেন কিশোরেরই জীবনদর্শন। ক্রমেই দেশের অন্যত্ম সেরা কিশোরকন্ঠী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। রমরমিয়ে চলে তাঁর মাচা শো।
এই মাচা করতে গিয়েই পরিচয় হয়েছিল স্ত্রী রীতার সঙ্গে। আলাপের পর পরই প্রেম, বিয়ে। লতাকন্ঠী ছিলেন রীতা। তবে ছেলে ঋষির জন্মের পর গান গাওয়া বন্ধ করে দেন। ঋষিও গান গায়। কিন্তু কিশোরে অনীহা তার। বরং গীটার বাজিয়ে রক গাইতেই অভ্যস্ত সে। ব্যান্ডের গাইয়ে ঋষি কিছুতেই মানতে পারে না কিশোর কুমারের প্রতি তার বাবার এই সমর্পণকে। বাবাকে কোনও শিল্পী মনে করে না সে। ভাবে স্রেফ একজন মাচা গায়ক, যে কিশোর কুমারের অনুকরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে নিজস্বতাই। অন্যদিকে, শোয়ের পর স্বামী মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে, গালিগালাজ করলে প্রতিবাদ করেন রীতাও। রোজ রাতেই চলে অশান্তি। আবার সকালে উঠে সেই স্বামীর সঙ্গেই খুনসুটি করতে দেখা যায় তাঁকে। একজন পাকা গৃহিণীর মতই স্বামীর সেবা-যত্নেও কোনও ত্রুটি রাখেননা।
ভারত সরকারের তরফে ভারত-পাক সীমান্তে একটি সম্প্রীতির জলসায় কিশোর কুমার জুনিয়রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। জয়সলমীরের সেই সঙ্গীত অনুষ্ঠানে আরও একাধিক কণ্ঠীর যেখানে উপস্থিত থাকার কথা। জয়সলমীর বিমানবন্দর থেকে বেরনোর পর হঠাতই হাইজ্যাক হয়ে যায় সস্ত্রীক কিশোর কুমার জুনিয়র এবং তাঁর যন্ত্রীর দল। ক্রমশ জানা যায় তাঁদের অপহরণ করেছে পাকিস্তানি ডাকাতের দল। এরপর কীভাবে তাঁদের দিন কাটবে, আর কীভাবেই বা তাঁরা সকলে মুক্তি পাবেন, সেসব জানতে গেলে দেখতে হবে ছবিটি। তবে স্ত্রী রীতার বাঙালি রান্নার গুণ, কিশোর কুমারের গানের ডাকাত দলের সদস্য ফিরোজ ও তার বাবার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এবং সর্বোপরি সঙ্গীতই কেমনভাবে জুনিয়রের পুরো দলটাকে বাঁচিয়ে দেয়, সেটাই চিত্রনাট্যের মূল আকর্ষণ।
কণ্ঠী শিল্পীর জীবনের গল্প দিয়েই ছবি শুরু হলেও, কৌশিক আসলে স্রেফ একজন কন্ঠী বা মাচা গায়কের গল্প বলতে চাননি বা তাঁর শিল্পী-জীবনের ওঠাপড়া দেখাতে চাননি। তিনি তাঁর গল্পকে অন্য পথে নিয়ে গেছেন। ফলে চিত্রনাট্যে যেমন রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বা বাবা-ছেলের দ্বন্দ, তেমনই রয়েছে নারীর জয়গান বা সম্প্রীতির বার্তা। একদিকে যেমন রয়েছে সাসপেন্স, থ্রিল; আবার তেমনই রয়েছে সিটি পড়ার মত সংলাপ ও হাস্যরস। তবে সরকারি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে শিল্পী অপহরণের খবরে ভারত সরকারের কেন তেমন কোনও হেলদোল দেখা গেল না কিংবা ডাকাতদলের ফিরোজের বাবা এখনও বেঁচে আছেন কিনা, সেসব স্পষ্ট নয়।
অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় প্রসেনজিত্ চট্টোপাধ্যায়ের কথা। ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ চরিত্রে তাঁকে ছাড়া টলিউডে আর অন্য কারোর কথা ভাবাই যায় না। এককথায় তিনি অনবদ্য। অন্যদিকে অপরাজিতা আঢ্যও এক আদ্যপ্রান্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত স্ত্রীয়ের চরিত্রে নিজের সেরাটা দিয়েছেন। ঋষির চরিত্রে ঋতব্রতর অভিনয়ও যথেষ্ট সাবলীল। তবে পার্শ্বচরিত্রে নজর কেড়েছেন লামা, মাসুদ আখতার। তবে এ ছবির অন্যতম প্রাপ্তি রাজেশ শর্মার বলিষ্ঠ অভিনয়।
মিউজিক এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিশোরের হিন্দি-বাংলা গানগুলির নির্বাচনই চিত্রনাট্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সেদিক থেকে সফল কৌশিক। ছবিতে প্রায় সবকটি গানই গেয়েছেন কুমার শানু। তাঁর গলায় কিশোরের গানগুলি নস্ট্যালজিয়া তৈরি করে দর্শকদের মনে। ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি মোটামুটি। গোপী ভগতের ক্যামেরায় জয়সলমীর দেখতে মন্দ লাগেনা। তবে এডিটিং আরও নিখুঁত হতে পারত। জুনিয়র এবং যন্ত্রীদের বন্দিপর্ব একটু বেশিই দীর্ঘ লাগে। কিছু অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিতে পারলে, ছবিটি মেদহীন হতে পারত।
তবে শেষে একটি কথাই বলার, এ ছবি প্রথম সেইসব কণ্ঠীশিল্পীদের নিয়ে কথা বলল যারা আজ আর ইন্ডাস্ট্রিতে সেরকম গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তাই তাঁদের আবেগ, নিত্যদিনের মাচা অনুষ্ঠানের শ্রম ও কষ্ট সেলুলয়েডে তুলে ধরার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য পরিচালক কৌশিকের। থ্রিলার এলিমেন্ট, সাসপেন্স, আবেগ এবং জনপ্রিয় গানের সমাহারে কিশোর কুমার জুনিয়র সত্যিই পুজোর ছবি। তাই পুজোর ছুটিতে হলে গিয়ে একবার দেখে আসতেই পারেন। কিশোর কুমার জুনিয়রের জিন্দেগির এই সফর মোটের উপর সুহানাই লাগবে।