পুজোসংখ্যা – বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক সিগনেচার। শারদসাহিত্যই ‘পুজো আসছে পুজো আসছে’ উত্তেজনাটা বাঙালির হৃদয়ে তিরতির করে বইয়ে দেয়। ঠিক কবে থেকে পুজোর আনন্দের সঙ্গে মিশে গেল সাহিত্যপাঠের অনাবিল আনন্দ? এখানেও রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল অবদান। বাঙালির হৃদয়ের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা মাখা শারদোৎসব দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভেবেছিলেন পুজোর ছুটির অবকাশে বাঙালি পাঠকের হাতে একখানি মোটাসোটা পত্রিকা তুলে দেবার কথা। ১২৯৮ সালের অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর নির্দেশনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকার প্রথম সংস্করণ। এই কাগজেরই ১২৯৯ সালে ভাদ্র-আশ্বিন যুগ্মসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল পুজোসংখ্যা হিসেবে।
কলকাতায় এই পত্রিকার সম্পাদনার সহায়ক ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই সংখ্যায় কবির ‘স্বর্ণমৃগ’ নামে একটি দীর্ঘ গল্প ছিল। সেও শরতের গল্প।
পুজোসংখ্যা কেনার লম্বা লাইন পড়ত আনন্দবাজার অফিসের ঠিক উল্টোদিকে পত্রিকার সেলস কাউন্টারে। আনন্দমেলা সারাবছরই আসত, কিন্তু পুজোসংখ্যা মানে স্পেশ্যাল! তাই অধীর অপেক্ষা। সেখানে দেখা হবে ফেলুদা, কাকাবাবু-সন্তু, প্রোফেসর শঙ্কু, কিকিরা, গোগোল, অর্জুন- সব্বার সঙ্গে! থাকবে টিনটিন আর কুট্টুসও! আর সেইসঙ্গে সেইসব ঝকঝকে রঙিন কিংবা সাদাকালো ছবি। কোন গল্পে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, কোনটায় বা সুধীর মৈত্র, কোথাও কৃষ্ণেন্দু চাকী কিংবা বিমল দাস, আবার কোনটায় সমীর সরকার কি অনুপ রায়ের দুর্দান্ত সব ছবি। এইসব ছবির হাত ধরে, গল্পের সঙ্গে সঙ্গে চলত কল্পনার জাল বোনা! অসামান্য কার্টুনের সম্ভার নিয়ে থাকতেন রেবতীভূষণ, দেবাশিস দেব। শুকতারা আর কিশোরভারতীর পুজোসংখ্যাও আছে। পুজোর ক’দিন পড়ার বই শিকেয় তুলে সব পুজোবার্ষিকী পড়ে ফেলতে হবে হুড়মুড়িয়ে। সেটাই নিয়ম!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কাকাবাবু’ নিয়ে হাজির। সঙ্গে সন্তু। সবসময়। কখনও কখনও জোজো। ভারি সহজ-সরল ভাবে লেখার সঙ্গে চরম উত্তেজনা। সবসময় একটা কি-হয় কি-হয় ব্যাপার! এটাই তাঁর এসব লেখাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে। গল্পের প্লটও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই গল্পের প্রথমদিকে সন্তু কিন্তু ছিল না। শুধু কাকাবাবু আর দেবলীনা কেওনঝড়ের রাজবাড়ি গেছিল। জোজো আর সন্তু কলেজের পরীক্ষা থাকায় গেছিল পরে। পরের দিকে কাকাবাবুর অ্যাডভেঞ্চার কখনো কখনো সাদামাটা লাগলেও পুজোসংখ্যায় কাকাবাবুর উপস্থিতি না হলেই নয়।
শৈলেন ঘোষের জাদু-কলমে রূপকথার গল্প পড়াও অসামান্য অভিজ্ঞতা। বন-সবুজের দ্বীপে, সোনাঝরা গল্পের ইনকা, মা এক নির্ভীক সৈনিক, গল্পের মিনারে পাখি- কত যে মন ভরানো লেখা!শৈলেন ঘোষের কলমের জাদুর সঙ্গে মিলত বিমল দাসের তুলির জাদু! আর তাতে ভর দিয়ে মন উড়ে যায় কল্পনার রাজ্যে।
এ তো গেল উপন্যাস আর গল্প! এর সঙ্গে থাকত শঙ্কু-কাহিনী, কয়েকটি কমিকস, টিনটিন-সহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলা নিয়ে একাধিক লেখা এবং সব শেষে সেই নিয়মিত ‘কী করে নম্বর বাড়াতে হয়।’ সব মিলিয়ে জমজমাট পুজোসংখ্যা! ঘুমোতে যাবার সময়েও সঙ্গী পুজোবার্ষিকী। পাশের বালিশে ঘুমোত বইগুলোও।
পাঠকরা আনন্দ পান নতুন, কালজয়ী লেখা পড়ে এবং অবশ্যই নবীন লেখকদের হদিশ পেয়ে। যেমন, ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গবাণী’র পুজো সংখ্যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘মহেশ’ গল্পটি। তেমনই, অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘দিগন্ত’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সন্তোষকুমার ঘোষের ‘কিনু গোয়ালার গলি’। আবার ‘দেশ’-এর পুজো সংখ্যাতেই জন্ম হয়েছিল বাঙালির প্রিয় ফেলু মিত্তিরের। এছাড়া ‘প্রসাদ’, ‘নারায়ণ’, ‘বিজলী’, ‘প্রবাসী’, ‘যমুনা’, ‘ভারতী’, ‘বসুমতী’, ‘এক্ষণ’-সহ নানা পত্রিকার পুজো সংখ্যাগুলিও ছিল নজরকাড়া।
অন্য লেখকটি, নবনীতা দেবসেন। ১৯৭৬ সাল। তখন তিনি পদ্যে বেশ পোক্ত। হঠাৎ একটি চিঠি পৌঁছল তাঁর কাছে। লিখেছেন রমাপদ চৌধুরী, উপন্যাস চেয়ে। তরুণ নবনীতার মনে হল, এ যেন ‘লেখার আগেই জ্ঞানপীঠ পেয়ে যাওয়া।’ লিখলেন তিনি। জন্ম নিল, ‘আমি, অনুপম’। জন্ম নিলেন উপন্যাসশিল্পী নবনীতাও। এমনই এক পুজোসংখ্যায়।
লেখক– কৌশিক ভট্টাচার্য