কলকাতার তথাকথিত ‘হেভিওয়েট’ পুজোগুলির মত জাঁকজমক পূর্ণ না হওয়ায়, তেমন ভাবে প্রচারে আসে না জেলার পুজোগুলি। তবে সারা রাজ্যেই এমনও অনেক পুজো হয়, যা প্রায় আড়াইশো-তিনশো বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। তেমনই বহরমপুরের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী হল কুঞ্জঘাটার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। এই পুজো ‘রাজা নন্দকুমারের পুজো’ নামেই পরিচিত। যদিও নন্দকুমারের পিতা পদ্মনাভ রায়ের সময় থেকেই এই পুজো শুরু হয়। তখন অবশ্য পুজো হত ভদ্রপুরে। নন্দকুমারের দৌহিত্র মহানন্দ ভদ্রপুর থেকে কুঞ্জঘাটায় দেবীর পাটাতন তুলে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
নন্দকুমারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা জানান, ১৬৩৫ সাল থেকে এখানকার পুজো ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। কোনও ছেদ পড়েনি। সমস্ত শাস্ত্রীয় বিধি মেনে পুজো করা হয়। পুজোয় এখানে মাসকলাই (এক প্রকার ডালশস্য) বলি হয়। রাজা-জমিদারদের আমল চলে যাওয়ার পর পুজোর আড়ম্বর কমে গেলেও সনাতন ঐতিহ্য মেনে আজও পুজো হয়।
পুজোর ভার এখনও নন্দকুমারের পরিবারের হাতে থাকলেও এই পুজোকে ঘিরে এলাকাবাসীর উৎসাহ চোখে পড়ার মত। স্থানীয় মানুষজন পুজোর ভোগ সাজানো থেকে শুরু করে আলপনা দেওয়া পর্যন্ত, প্রায় সব কাজেই অংশ নিয়ে থাকেন। এর সঙ্গে অঞ্জলি দেওয়া, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি তো রয়েইছে।
জানা গেছে, পদ্মনাভ রায় নবাব আলিবর্দির রাজস্ব বিভাগের কর্মী ছিলেন। যখন ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গি হামলা হয়, তখন নন্দকুমার সেই খবর নবাবের কানে তুলেছিলেন। সেই সুবাদে নবাব তাকে নবাবি রাজস্ব সংগ্রহ করার কাজে বহাল করেন। পিতা-পুত্রের যৌথ আয়ে রায় পরিবারের অবস্থা ক্রমেই ভাল হতে থাকে। কালক্রমে নন্দকুমার মহারাজা উপাধি লাভ করেন। এর আগেই অবশ্য পদ্মনাভ দুর্গাপুজো চালু করে দিয়েছিলেন।
বহু সাবেক পুজোর মতো এই পুজোকে কেন্দ্র করেও বহু কাহিনী, বহু কিংবদন্তী শোনা যায়। যেমন, নবাবি আমলে, প্রতিবার দেবী প্রতিমা বিসর্জনের পরেই নদীতে একটি মাঝিমাল্লাহীন ময়ূরপঙ্খী বজরা দেখা যেত। সেই বজরা নাকি স্রোতের টানে দেবীর কাঠামো ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত। এবং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন কাঠামোকে ফের নদীর ঘাটে পাওয়া যেত।
ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় দেবী মূর্তি থানে ওঠেন এই কুঞ্জঘাটার রাজবাড়িতে। পুজো হয় শাক্তমতেই। তবে এই পুজোয় পশুবলির চল নেই। কিন্তু প্রতীকী হিসেবে এখানে মাসকলাই বলি হয়। মাসকলাইয়ের ডানায় হলুদ মাখিয়ে মাটির ছোট ভাঁড়ে রাখা হয়। পরে তা ভেঙে ফেলা হয়, সেটাই বলি। অতীতে পুজো উপলক্ষে যাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। কালের গতিতে সে সব হারিয়ে গেলেও পুজোর আভিজাত্যে টোল পড়েনি আজও।