‘অন্তরে যা লুকিয়ে রাজে
অরুণবীণায় সে সুর বাজে—
এই আনন্দযজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ।‘
মহালয়ার দিন ভোরবেলায় ওঠাটা যেন নিয়ম। সবাই বেশ পালনও করত। আগের দিন থেকেই ছোটদের মনে চাপা উত্তেজনা। রাত পোহালেই মহালয়া, তারপরেই স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। একমাস ছুটি। কি আনন্দ! পরীক্ষার আগে ভোরবেলা উঠে লেপ মুড়ি দিয়ে পড়তে বসেছি দু-একবার। আলাদা করে ভোরের আকাশ দেখা হয়নি কখনও, মহালয়ার দিন ছাড়া। আবির ছড়ানো ভোরের আকাশ। হালকা শীত শীত ভাব। টিনের চালে শিশিরের টুপটাপ। শব্দ বলতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের মন্দ্রকন্ঠ।
একদম ছোটবেলায় বাবা রেডিও চালিয়ে দিয়ে তুলে দিত। গান আর কথার মানে কিছু না বুঝলেও শোনাটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। শুধু তাই নয়, মহালয়া এতোটাই পরিচিত যে, ঘুম ভাঙার পর বলে দিতে পারতাম সবে শুরু, নাকি আরও অনেক বাকি। ভোরের হালকা আলোয় শুনতে ভালোও লাগৎ খুব। পরদিন সকালে চায়ের আসরে – কে কখন উঠেছে, কে পুরোটা শুনেছে, কেউ আদৌ শুনেছে কিনা তাই নিয়ে চলতো বিস্তর আলোচনা।
একটু বড় হয়ে রেডিওয় মহালয়া শোনা শেষ হলে, চলে যেতাম মেজোমার বাড়ি। টিভিতে দেখার জন্যে। গ্রামে তখন মাত্র দুটো টিভি। একটা ক্লাবে, আর একটা মেজোমাদের। দুটোই সাদা-কালো। ক্লাব একটু দূরে। তাই মেজোমার বাড়ি। ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে একটা ঝামেলা হওয়ায় তাদের টিভিটা বন্ধও ছিল বহুদিন। তাই মেজোমার বাড়িতে ভিড়টা যেতো বেড়ে।
পাশের গ্রাম থেকেও অনেকে আসত। টিভির একদম সামনে বসা দরকার। শুরুর অনেক আগে গিয়ে সেজদাকে তাড়া দিতাম, ঘর থেকে টিভিটা বারান্দায় বের করে দেওয়ার জন্যে। বিশাল বড় ফাঁকা বারান্দার এদিক থেকে ওদিক লোক থিক থিক করতো। পরে ক্লাবের টিভি আবার চালু হওয়ায় ভিড়টা কমে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে সাদা-কালো টিভির ভিড় বাড়লো। কিছুদিন পর আমাদের বাড়িতেও এলো টিভি, একেবারে রঙিন। পাশাপাশি দু-তিনটে গ্রামের মধ্যে প্রথম। তাই ভিড়ও হত খুব। রঙিন টিভি হওয়ায় মহিষাসুরমর্দীনিকে সত্যিকার ঠাকুরের মতো লাগত। ছোটঠাকুমা মহালয়া শুরুর আগে টিভির সামনে ধূপ দিয়ে প্রণাম করে বসে পড়তেন। সবাই হাসত। সব হইহই নিমেষে থেমে যেত ছোটঠাকুমার উপেক্ষায়।
সেজদাদু প্রতিবছর মহালয়ার দিন বলতো – ‘আগে আমাদের বাড়িতে কলের গান চালানো হতো, তখনও প্রচুর লোক ভিড় করে বসে শুনত।‘ আমি এখন মোবাইলে গান চালাতে শিখে গেছি, কলের গান কখনও চালাইনি। শুধু যন্ত্রটা দেখেছি। সেজদাদু, ছোটঠাকুমা, কলের গানের ঠিকানা আজও বদলায়নি।
এখন কারও বাড়িতে রেডিও আছে কিনা জানিনা। সাদা-কালো টিভি তো নেইই। আমাদের বাড়িতেই চারটে টিভি। দোতলায় দুটো, একতলায় দুটো। তারমধ্যে একটা এল-সি-ডি। ভোরের আকাশ কেউ দেখে কিনা জানি না, তবে টিভিতে মহালয়া এখনও সবাই দেখে।
আর কয়েকদিন পর থেকেই সিগনালে, বন্ধ ফ্ল্যাট থেকেও কানে আসবে – ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু।‘
(মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত)