একের পর এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেই চলেছে ভারতের শীর্ষ আদালত। বৃহস্পতিবার দুটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ের পর শুক্রবার কেরালার শবরীমালা আয়াপ্পা মন্দিরে প্রবেশ মামলায় যুগান্তকারী রায়দান করল সুপ্রিম কোর্ট৷ শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশে কোনও বাধা নেই বলে শুক্রবার স্পষ্ট জানিয়ে দিল শীর্ষ আদালত। এদিন শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ধর্মাচরণে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। এতে শারীরিক গঠন কখনই ভগবান ও ভক্তের মাঝে বাধা হতে পারে না। একই সঙ্গে এদিন আদালত জানিয়ে দেয়, ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ঋতুমতী মহিলাদের জন্যও শবরীমালা আয়াপ্পা মন্দিরের দরজা খোলা থাকবে। মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার শামিল বলেই মনে করে শীর্ষ আদালত। সুতরাং এবার থেকে শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলারাই প্রবেশ করতে পারবেন। এর ফলে বাতিল হয়ে গেল ৫৩ বছরের পুরনো প্রথা।
কেরালার শবরীমালা মন্দিরের আরাধ্য দেবতা আয়াপ্পা স্বামী। এই মন্দিরে ১০ থেকে ৫০ বছরের মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বহু প্রাচীন এই প্রথাকেই চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দায়ের হয়। সব মামলা একত্রিত করে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাংবিধানিক বেঞ্চে আট দিনের শুনানি শেষ হয় গত পয়লা অগস্ট। ওই দিনই শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, রায় দেওয়া হবে ২৮ সেপ্টেম্বর।
মামলার পর্যবেক্ষণে দেশের শীর্ষ আদালতের বক্তব্য ছিল, ‘মন্দির হল জনগণের সম্পত্তি। সেখানে যদি একজন পুরুষের প্রবেশাধিকার থাকে, তা হলে একই ভাবে মহিলারও প্রবেশাধিকার থাকবে। ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে বৈষম্য চলবে না। এই নিয়ম হিন্দু মহিলাদের অধিকার খর্ব করছে। তাই ১০ থেকে ৫০ বছরের মহিলাদের শবরীমালা মন্দিরে ভগবান আয়াপ্পার পুজো দেওয়ার উপর যে বিধিনিষেধ রয়েছে তা পুরোপুরি অসাংবিধানিক।’ সাংবিধানিক বেঞ্চের পাঁচজন বিচারপতির মধ্যে চারজনই এই রায়ে সম্মত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের প্রশ্ন, মন্দির খোলা থাকলে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। সেখানে অস্পৃশ্যতার কারণ দর্শিয়ে কী করে নির্দিষ্ট বয়সসীমার মহিলাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়? তাঁর কথায়, বলেন, ‘ভগবানের পুজো করার অধিকার সবার রয়েছে। লিঙ্গের ভিত্তিতে কারোর কাছ থেকে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। ভগবানের পুজোর জন্য শারীরিক বা দৈহিক কোনও ক্রিয়া বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নারী কখনই পুরুষের সম্পত্তি নয়। একদিকে, নারীকে দেবীরূপে পুজো করা হচ্ছে। অন্যদিকে, তাঁদের প্রবেশেই চাপানো হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ১০ থেকে ৫০ বছরের মহিলাদের ক্ষেত্রে শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা সাংবিধানিক নীতিকে লঙ্ঘন করে। ভগবান আয়াপ্পার ভক্তরা সবাই হিন্দু। তাই তাঁদের মধ্যে পৃথক শ্রেণি তৈরি করা যাবে না।’ বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের মত ছিল, সংবিধানের ২৫ ধারা অনুযায়ী দেশের সব নাগরিক যে কোনও ধর্মস্থানে যাওয়ার অধিকারী। সব মহিলাই ঈশ্বরের সৃষ্টি। তা হলে কেন পুজোপাঠ বা কর্মস্থানের অধিকার নিয়ে মহিলাদের সঙ্গে ভেদাভেদ করা হবে?
তবে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চেরই এক বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে এই রায়ে একমত পোষণ করতে পারেননি। যদিও তিনি নিজেও একজন মহিলা। বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রার মতে, এই বিষয়টির সঙ্গে গভীরভাবে ধর্মীয় রীতি জুড়ে রয়েছে। দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য এই ইস্যুটি নিয়ে আরও একবার ভাবা দরকার ছিল। ‘সতি’র মত সমাজের মন্দ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করাই আদালতের মূল উদ্দেশ্য, কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া আদালতের কাজ নয়।
তিনি বলেন, ‘আর্টিকাল ২৫ অনুযায়ী উপাসনাগৃহে সকলের প্রবেশের অধিকার রয়েছে। সেটা মৌলিক অধিকারের মধ্যে ধরা হয়। কিন্তু যুক্তিসঙ্গত ধারণা কোনওভাবে ধর্মের মধ্যে আনা যাবে না।’ তিনি আরও জানান, এই বিষয়টি শুধুমাত্র শবরীমালা নিয়ে নয়। অন্যান্য অনেক মন্দিরেই এ ধরনের রীতি রয়েছে। দশকের পর দশক ধরে মেয়েদের ঋতুমতী হওয়ার দোহাই দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। আসলে ভগবান আয়াপ্পাকে শবরীমালা মন্দিরে ব্রহ্মচারি হিসাবে পুজো করা হয়।
এদিকে, আদালতের এই রায়ের পর শবরীমালা মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাঁরা পরবর্তীতে রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন। প্রসঙ্গত, কেরলের শবরীমালা মন্দিরে ভগবান আয়াপ্পাকে ব্রহ্মচারী হিসেবে পুজো করা হয়। মন্দিরে পুজো দিতে গেলে ৪১ দিনের একটি রীতিও পালন করতে হয় ভক্তদের। কিন্তু ১০ থেকে ৫০ বছরের মহিলারা ঋতুমতী হওয়ায় এই নিয়ম তাঁরা পালন করতে পারেন না। আর তাই দীর্ঘদিন ধরে শবরীমালা মন্দিরে তাঁদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এরপর সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়মের বিরুদ্ধে একাধিক পিটিশন দায়ের হয়। আর শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চের এদিনের রায়ে মহিলাদের উপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা অবশেষে উঠে গেল। তবে ইতিমধ্যেই এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পুনরায় অনেকেই ফের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে।