আজ সকাল থেকে আমার মৌসুমি ভৌমিকের গানের একটা লাইন মনে পড়ছে- ‘যশোর রোড যে কত কথা বলে।’ ৭১এর মুক্তি যুদ্ধের সময় যশোর রোডে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা দেখে বিচলিত বিট কবি অ্যালেন গিনসবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে কবিতাটি নিয়ে মৌসুমি এই অসাধারণ গানটি বানিয়েছিলেন। বন্ধু গিনসবার্গের কবিতাটি নিয়ে বব ডিলানও তৈরি করেছিলেন একটি গান। সত্যি যশোর রোড যে কত কথা বলে, কত কিছু দেখে! ৭১এ শরণার্থীদের মৃত্যু ও দুর্গতি দেখার পর এখন সে দেখছে গাছের মৃত্যু। সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে যশোর রোডে ৩৫৬টি গাছ কাটার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। যশোর রোডে লাগামছাড়া অযৌক্তিক বৃক্ষবিনাশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে এপিডিআর। এই স্থগিতাদেশ তাদের আইনি যুদ্ধকে এক ধাপ এগিয়ে দিল।
একটা জিনিস আমার খুব অবাক লাগে। বারবার দেখি উন্নয়ন কথাটার সঙ্গে পরিবেশ ধ্বংস করার কথাটা জুড়ে যায়। অথচ উন্নয়ন ও পরিবেশ কেউ কারো শত্রু নয়। পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন কি হতে পারে? উন্নয়নের একটা শর্ত তো জল, বাতাস, আলো মানে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে আমাদের যা লাগে তা ঠিকঠাক ও দূষণহীনভাবে পাওয়ার ব্যবস্থা করা। পরিবেশকে ধ্বংস করলে, গাছ কাটলে তা হবে কেমন করে? এই সড়কে গাছ কাটার পিছনে কেউ যুক্তি দিচ্ছেন গাছগুলোর বয়স হয়েছে, রাস্তার দুপাশ জুড়ে বিরাট জায়গা দখল করে সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তা কেটে না ফেললে রাস্তা চওড়া হবে কেমন করে?
আচ্ছা, বয়স হয়েছে বলে আমরা কি বাবা মাকে বাড়ি থেকে বার করে দিই? বয়স হয়ে গিয়েছে বলেই তারা যে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবদিকে নজর রেখে স্বাধীনভাবে চলাফেরার উপযুক্ত করে তুলেছেন, তা কি আমরা ভুলে যাবো? এটা করা মানে তো নিজেদের আত্মপরিচয়কেই অস্বীকার করা। আইনও একাজ সমর্থন করে না। বৃদ্ধ বাবা মা-র ভরণপোষণের দায়িত্ব অস্বীকার করা তো আইনি অপরাধ। ঠিক তেমনই যে বৃক্ষ আমাদের ছায়া, হাওয়া,ফল, ফুলে ভরিয়ে তোলে তাকে আমরা ভুলে যাবো কেমন করে? কেন তাকে মানুষের সংসার থেকে বিদায় জানাবো? যান চলাচলের পথ সুগম করার জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা কেন ভাবছি না আমরা? পথে ডিভাইডার তৈরি করে সেখানে গাছ লাগিয়ে রাস্তা চওড়া করা, যাত্রী পরিবহণের চাপ কমানোর জন্য সমান্তরালভাবে রেলপথ সম্প্রসারণ করার কথা ভাবা হচ্ছে না কেন? শুধুই রাস্তার দুপাশে শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলি কেটে ফেলার কথা ভাবা হচ্ছে। এই গাছগুলির মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে যশোর রোডের সেকাল থেকে একালে হেঁটে আসার ইতিহাস।
যশোর রোড মানেই একটা ছায়াময় ও মায়াঘেরা রাস্তা। এই রাস্তার দুপাশে ছিল সারি সারি শিশু, শিরিষ, মেহগনি, অশ্বথ, বট, আম, জাম গাছ। গাছগুলোই এই রাস্তার মূল আকর্ষণ। গাছগুলোই হেরিটেজ। দেশি বিদেশী পর্যটকেরা তা দেখতেই আসেন। গ্রীষ্মের দিনে পথিকরা তো এর ছায়াতেই বসেন। মাইলের পর মাইল এই সড়ক ঠাণ্ডা থাকে গাছের ছায়ায়। গাছগুলো ঘিরেই বহু মানুষের জীবনজীবিকা। আবার একটা বড় গাছ মানেই তাকে ঘিরে একটা জীববৈচিত্র। সেখানে খরগোশ, কাঠবেড়ালি, ভাম, শেয়াল, বেজি, পাখি, সাপের সংসার, নানা ধরণের পোকামাকড়ের আনাগোনা। গাছ কাটা মানে এই জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া। অথচ ১৫০-২০০বছর প্রাচীন প্রায় ৪০ফুটেরও বেশি উঁচু এই পেল্লায় গাছগুলো উন্নয়নের নামে লাগাতারভাবে কাটা পড়ছে! আমার প্রশ্ন, এগুলি কেটে ফেলার পর পরিবেশে কি প্রভাব পড়বে তা নিয়ে কি কোন সমীক্ষা হয়েছে? সেই সমীক্ষায় কি গাছ কাটার কথা বলা হয়েছে?
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা কিন্তু অন্য কথা বলেন। তাদের মতে, বড় গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে। তার শিকড়বাকর মাটিকে আলগা হতে দেয় না। যে রাস্তা চওড়া করার এবং ১৬মিটার চওড়া ওভারব্রিজ তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে মাটি আলগা হয়ে রাস্তা বসে গেলে তা হবে কেমন করে? যদিও ৫মিটার চওড়া রাস্তার জন্য কেন ১৬মিটার চওড়া ওভারব্রিজ করার দরকার হচ্ছে তার কারণটাও পরিষ্কার নয়! গাছ কাটার পর পরিপূরক বৃক্ষ রোপণের পরিকল্পনার ব্যাপারেও তারা নীরব। যে গাছগুলি কাটা হবে তার আর্থিক মূল্যও কম নয়। যশোর রোডে বৃক্ষবিনাশ যজ্ঞে একেবারে প্রথম পর্বে যে ৪০৩৬টি গাছ চিহ্নিত করা হয়েছিল তার মধ্যে ২০০০টিই ছিল মেহগনি গাছ। অধিকাংশই ১৫০বছরের বেশি পুরনো। শুধু কাঠ হিসেবেই তার দাম প্রায় ২০লাখ টাকার বেশি। সেই ৪০৩৬টি গাছ অবশেষে নেমে এসেছিল ৩৫৬টি গাছে। সুপ্রিম কোর্ট সেই গাছগুলি কাটার বিরুদ্ধেই অনির্দিষ্টকাল স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
পৃথিবীর কোন দেশে পুরনো ঐতিহ্য, বৃক্ষ, বাগান, নয়ানজুলি, পুকুর, নদী দখল করে উন্নয়ন হয় না। এখানে তো গঙ্গাপাড়েও গজিয়ে ওঠে খাটাল, সৌন্দর্যায়নের নামে গঙ্গা দখল করেও গড়ে ওঠে নির্মাণ। উন্নয়ন নিশ্চয় দরকার, এ প্রশ্নে কোন আপোষ চলে না। তার জন্য সাময়িক অসুবিধাও মানুষ সহ্য করতে তৈরি। কিন্তু তার জন্য সুস্থ জীবনযাপনের প্রাথমিক শর্ত পরিবেশকে ধ্বংস করা যায় না। অকারণে ব্যাপকহারে গাছ কাটা মানেই পরিবেশ ধ্বংস করা। আমরা জীবনের অভিজ্ঞতায় বারবার দেখছি পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গড়ে ওঠা কোন কিছুই সুস্থায়ী হয়না। সাম্প্রতিক সময় কেরালার মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় একথা আমাদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের আরও বেশি সাবধান হতে হবে।
মৌসুমির ঐ গানটারই আরেকটা চমৎকার লাইন মনে পড়ে গেল, ‘আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে?’ সত্যিই তো আদালতের পক্ষে তো আর বৃক্ষের নালিশ শোনা সম্ভব নয়। নির্বাক বৃক্ষের নালিশের ভাষা পড়তে হবে মানুষকেই। মানুষই তো দিয়েছে তার প্রাণের স্বীকৃতি। এই ভাষা আমরা ঠিকঠাক পড়তে শিখলে পরিবেশ আর উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে শিখবে।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
অশোক মজুমদার
লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রথিতযশা চিত্র সাংবাদিক