রূপকথার গল্পে আমরা কুমীরের দেখা পাই, যে বাঁদরকে তার পিঠে করে বেড়াতে নিয়ে যাবার ছলে তাকে পেটে পুরতে চেয়েছিল। মনে পড়ছে সেই শঠ শিয়ালটার কথা, যে সারসকে নেমন্তন্ন করে তাকে থালায় খেতে দিয়ে বোকা বানিয়েছিল। আজ আমাদের দেশে ধর্মের নাম করে ঠিক তেমনই একটি রাজনৈতিক দল মানুষকে বোকা বানাতে চাইছে, খুন করতে চাইছে মনুষ্যত্বকে। এই অধর্মের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই অবিস্মরণীয় লাইন – ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। ইতিহাসের এ এক পরম কৌতুক যে, ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যকে আত্মস্থ করার শক্তি বোঝাতে শক হূন দল পাঠান মোগল কে এক দেহে মিলে যাওয়ার উপমা দিয়েছিলেন যে কবি, সেই রবীন্দ্রনাথকেও ব্যবহার করছে বিজেপি।
নিজেদের মুখচ্ছবি উজ্জ্বল করার জন্য তারা ব্যবহার করছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। দিল্লির মৌলানা আজাদ রোডে একটা ফ্লেক্সে তারা গুরুবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মপরিচয় থেকে তাঁর একটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছে। আজও কয়েক কোটি মানুষের নাম রাম ও কৃষ্ণ। আজও রামনবমী ও জন্মাষ্টমী পালিত হয়। একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব আজও যে নামের সঙ্গে জড়িত, তা হল হিন্দু রাষ্ট্র। শুনেছি, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। বিজেপি ছুঁলে যে কী হয় তা রবীন্দ্রনাথকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রবীন্দ্র গবেষকরা তাঁর এমন কোন বক্তব্যের খোঁজ পান নি। আমারও মনে পড়ছে না কিছু।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিজেপি এখন হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই আঁকড়ে ধরছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শম্ভুলাল কাউকেই তারা ছাড়ছে না। আপনি ভাবছেন, রবীন্দ্রনাথ তো বুঝলাম কিন্তু শম্ভুলালটি কে? তিনিও গুণী মানুষ। পুরো নাম শম্ভুলাল রেগা। তার গুণপনা আর বিজেপির বিবেচনার কথা আপনাদের একটু মনে করিয়ে দিই। এই শম্ভুলালের নাম গত ডিসেম্বরে ভেসে উঠেছিল গণমাধ্যমে। মালদা থেকে রাজস্থানে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক মহম্মদ আফরাজুলকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে। গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের পোস্টার বয় শম্ভুলাল সেকথা কবুলও করেছিল। আফরাজুলের বয়স পঞ্চাশেরও ওপরে, লাভ জেহাদের অভিযোগ এনে তাকে খুন করা হয়েছিল। জেলে থাকা এই শম্ভুলালকে আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী করতে চাইছেন বিজেপি ঘেঁষা একটা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠন উত্তরপ্রদেশ নবনির্মাণ সেনা। বোঝাই যাচ্ছে গোঁড়া হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা কোন যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারেন না।
ভারতের ভবিষ্যৎ এখন ঠিক করতে চাইছে আরএসএস। তাদের সদ্য সমাপ্ত তিনদিন ব্যাপী অধিবেশনে ধর্মের পিলে চমকানো ব্যাখ্যা হাজির করেছেন সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। তার মতে রাম হচ্ছেন ইমাম-এ-হিন্দ। তিনি শুধু সংখ্যাগুরুদের দেবতাই নন, সবার দেবতা। মাইনরিটি কথাটাতেই ভাগবতের আপত্তি আছে। ধর্মের ভিত্তিতে গোটা দেশটাকে আড়াআড়ি ভাবে ভাগ করে ভোটে জেতার রাজনীতি যারা করছে সেই বিজেপি – আরএসএস এখন বলছে তারা দেশে সবাইকে নিয়ে থাকতে চায়। হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার জন্য তাক থেকে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা সবাইকে টেনে নামাচ্ছেন তারা। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য ব্যবহার করছেন মনীষীদের নাম।
এই মরীয়া চেষ্টা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকেই প্রকট করে তুলেছে। মোহন ভাগবতের ভাষণ থেকে বিজেপির নানাস্তরের নেতাদের প্রচারের ধরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, তারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শকে একটা ইনক্লুসিভ মানে যেখানে সব মতকে গ্রহণ করার সহিষ্ণুতা আছে তেমন একটা মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। এখন তারা স্বীকার করছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের অবদানের কথা, হিন্দুদের মুসলমানদের নিয়ে চলার কথা। সবটাই তাদের ব্র্যান্ড বিল্ডিং এক্সারসাইজ বা ভাবমূর্তি নির্মাণ প্রক্রিয়া। কিন্তু জেএনইউ নির্বাচনে হারার পর তাদেরই ছাত্র সংগঠন জয়ী ছাত্রনেতাদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যে হামলা চালাচ্ছে তা তাদের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দিচ্ছে।
শম্ভুলালকে ভোটে দাঁড় করানোর উদ্যোগ ধর্মান্ধতার রাজনীতির এক সগর্ব ঘোষণা। এবারে রামনবমীতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদে ট্যাবলোতে রাম-সীতার পাশেই জায়গা পেয়েছিল শম্ভুলাল রেগা। যারা তাকে ভোটে দাঁড় করাচ্ছেন মতাদর্শের দিক থেকে সেই বিজেপি ঘেঁষা সংগঠন উত্তরপ্রদেশ নবনির্মাণ সেনার মতে, তার অপরাধ এখনও প্রমাণিত হয়নি তাই তাকে প্রার্থী করা হয়েছে। আতিফ আহমেদ, মুখতার আনসারি, রাজা ভাইয়া, সাহাবুদ্দিনের মত লোকজনেরা প্রার্থী হতে পারলে শম্ভুলাল পারবেন না কেন? হিন্দুত্বের জয়গান গাওয়াটাই আমাদের প্রার্থীর যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। আমরা স্রেফ হিন্দুত্ববাদী প্রার্থী চাইছি।
বিজেপি জানে এবারের ভোটে তারা তাদের পুরনো ব্র্যান্ডের গোবলয়ের জঙ্গি হিন্দুত্ব আর বিক্রি করতে পারবে না। তাই মুখে লাগিয়ে নিচ্ছে একটা ভাল মানুষের মুখোশ। টেনে আনতে চেষ্টা করছে বুদ্ধিজীবীসহ নানাস্তরের পরিচিত ব্যাক্তিত্বদের। কিন্তু তবুও নানা ঘটনায় তাদের সাম্প্রদায়িক মুখটা বারবার সামনে চলে আসছে। মানুষ বুঝে ফেলছে এদের রাজনীতি শুধু ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধানোর রাজনীতি। এ শুধু মারা আর মরার রাজনীতি। এ রাজনীতি অন্ধত্বের। তাদের এই স্ববিরোধ ও দ্বিচারিতা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরার মধ্যে দিয়েই আজকে দেশের ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি এগোবে। মানুষকে বোঝাতে হবে বিজেপির দাঙ্গার ধর্ম রবীন্দ্রনাথের বলা মানুষের ধর্ম নয়। ঐ একই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/ শাস্ত্র মানেনা, মানে মানুষের ভালো। বিভেদের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হলে আমাদের আজ বুদ্ধির আলো জ্বালাতে হবে আর মানুষের ভালো করাটাকেই মনে করতে হবে ধর্ম।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
অশোক মজুমদার
লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রথিতযশা চিত্র সাংবাদিক