স্পষ্ট কথা বলা ভাল, যা বলতে চাই তা জোর গলায় বলা আরও ভাল কিন্তু জোর গলায় ভুল কথা বলা মোটেই ভাল না। সম্প্রতি আরএসএস-এর মুখপত্র স্বস্তিকা পত্রিকার সম্পাদক রন্তিদেব সেনগুপ্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের স্বামীজিদের আক্রমণ করে যে মন্তব্য করেছেন তা দেখে আমার এটাই মনে হল। রন্তির বক্তব্যের মোদ্দা কথাটা হল, স্বামী সুহিতানন্দ ও সুধীরানন্দের মত মিশনের সন্ন্যাসীরা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তোষামোদ করছেন। সত্যিই কী ব্যাপারটা তাই! সাংবাদিকতার সূত্রে রন্তি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। রাজনৈতিক সাংবাদিক এবং উত্তর সম্পাদকীয় লেখক হিসেবে পরিচিত নাম। বামপন্থী পরিবারে তার জন্ম। বাবা প্রয়াত সুনীল সেনগুপ্ত এবং মা প্রয়াত গীতা সেনগুপ্ত দুজনেই ছিলেন রাজ্যের বামপন্থী আন্দোলনে সামনের সারির মানুষ। সে এরকম ভুল কীভাবে করল তা ভাবতে আমার সত্যি অবাক লাগছে! বিশ্বাসের বদল হলে কারো কান্ডজ্ঞান যে এমন শূন্য হয়ে যেতে পারে তা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন!
রন্তির পোষ্টে দেখলাম, সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মধ্যমেধার রাজনীতিবিদ বলে অভিহিত করেছে। ধরেই নিচ্ছি সে একজন উচ্চমেধার মানুষ। তার কাছে আমার ছোট্ট জিজ্ঞাসা, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার অনেক আগে থেকেই দিদির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের যোগাযোগ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা, ত্রাণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ- সারদা- বিবেকানন্দের মন্ত্রে দীক্ষিত এই সন্ন্যাসীরা দেশজুড়ে যে ব্যাপক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছেন, সেই প্রয়াসে তিনি সবসময় তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বেলুড় স্টেশন ও সংলগ্ন রাস্তাঘাটের উন্নতি করেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও মঠ ও মিশনের সহায়তার জন্য তিনি সবসময় চেষ্টা করে চলেছেন। বিজেপির মদতপুষ্ট বিমল গুরুংদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন নিবেদিতার স্মৃতিবিজড়িত রায় ভিলা। এসব তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অন্যদিকে নিজেদের সেবাধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই সহায়তাটুকু মঠ ও মিশনের প্রাপ্য। মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এই মুখ্যমন্ত্রী তাদের যে সহায়তা দিচ্ছেন তা আগের সব সহায়তাকে ছাপিয়ে গেছে। এই কাজের জন্য সন্ন্যাসীরা যদি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেন, তাহলে রন্তির আপত্তি কোথায়? যদি সে বলে, কোন কাজই হয়নি, পেটোয়া সন্ন্যাসীদের দিয়ে এসব বলানো হচ্ছে তবে তাকে তা প্রমাণ করতে হবে।
মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা তাদের সেবামূলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সবারই সহায়তা চায়। প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য কর্পোরেট থেকে সাধারণ মানুষ সবার সহায়তা তাদের দরকার। এটা তাদের বহুদিনের ঘোষিত আদর্শ। মঠ ও মিশনের দরজা সবার জন্য খোলা। চিরকালই সব দলের নেতা নেত্রীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভাল। বহু ব্যাক্তি, সংগঠন, সরকার তাদের নিজেদের মত করে সহায়তা করেন। সত্যি বলতে কী এই সহায়তাটুকু ছাড়া তারা কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। আবার সরকার থেকে শুরু করে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তা নেন তারা জানেন, মিশনের সহায়তা তাদের কাজকে অনেক এগিয়ে দেয়। কেরলের বন্যাত্রান থেকে শুরু করে অতীতের বহু ঘটনায় আমরা এর নজির দেখেছি।
সরকারের প্রতিনিধি ও মিশনের স্বামীজিদের কথায় এই স্বীকৃতিটুকু থাকাটাই তো স্বাভাবিক। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যদি কোন একটা প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাকে তো সরকার বা সেই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, পুরসভা, জেলা পরিষদ ইত্যাদির কাছে কোন না কোন পরিকাঠামোগত সহায়তার জন্য যেতেই হবে। এই যাওয়াটা তো কোন তোষামোদ বা তেল দেওয়া নয়। স্বস্তিকা দপ্তরে জল সরবরাহ বা বিদ্যুতের জন্য তো পুরসভার সহায়তা নিতেই হবে। আর এই সহায়তা পাওয়ার পর যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুরসভাকে ধন্যবাদ দেন তাহলে সেটা তেল দেওয়া হবে কেন? এটা তো একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
আমার সাংবাদিক জীবনে ইন্দিরা গান্ধীকে বহুবার বেলুড় মঠে আসতে দেখেছি। তিনি ভরত মহারাজের কাছে আসতেন। নেহরু পরিবারের কাছে সঙ্গে বেলুড় মঠ ও মিশনের দীর্ঘকালের সম্পর্ক। জওহরলাল যখন জেলে ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী কমলা নেহরু জেলে স্বামীকে দেখতে আসতেন। ইন্দিরা তখন খুব ছোট। তাকে জেলে নেওয়া যাবে না। কমলা ইন্দিরাকে ভরত মহারাজের কাছে রেখে যেতেন। এটা কি ভরত মহারাজের নেহরু পরিবারকে তেল দেওয়া হল? না, বেলুড় মঠটা কংগ্রেসের সম্পত্তি হয়ে গেল? স্বাভাবিক ঘটনাকে যারা বিকৃত করেন তারাই এরকম ব্যাখ্যা দেবেন।
বিজেপির খপ্পরে পরে আমার বন্ধুর ভাবনাচিন্তাই কেমন যেন গুলিয়ে গেছে। তাই সে ধরে নিয়েছে দিদি রামকৃষ্ণ মিশনকে রাজনীতির আখড়া বানাচ্ছেন। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দকে যারা নিজেদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত বলে মনে করেন তারা তাদের উপাস্যদের এত দুর্বল মনে করবেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর মিশনের কাজকর্মের স্বীকৃতিকে তারা মনে করছেন রাজনৈতিক ভাষণ। তারা মনে করেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ শুধুই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারীদের সম্পত্তি। আমার তো মনে হয় রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ধর্মভাবনার সঙ্গে মোদী-অমিতদের জঙ্গি ও আগ্রাসী হিন্দুয়ানার কোন সম্পর্ক নেই। তারা ভুলে গেছে স্বামীজির সেই কথা, ঘৃণার শক্তির চেয়েও প্রেমের শক্তি অনেক বড়। ২০১৯ এর ভোটের কথা ভেবেই এই দলটি তাদের বুকের ব্যাজে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ছবি আটকে নিচ্ছে। আমার মনে হয়, নিম্নবর্গের মানুষদের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচার ও শোষণকে যারা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ বলে মনে করে, যারা দেশজুড়ে দলিত ও আদিবাসীদের ওপর লাগাতার আক্রমণ নামিয়ে আনে, তাদের এই দুজনের নাম উচ্চারণের কোন অধিকার নেই। মিশনের দীক্ষিত শিষ্য হয়েও রন্তি কী করে দলিতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে বিবেকানন্দের সেই ডাক ভুলে গেল তা ভাবতে আমার আশ্চর্য লাগছে! অবশ্য এই ভুলে যাওয়ার উদাহরণ আরও আছে। আরএসএস-এর মাধব রাও, সদাশিব গোলওয়ালকার মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট স্বামী অখন্ডানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সে দীক্ষার মর্ম তিনি বোঝেন নি, তার চিত্ত খণ্ডিতই রয়ে গেল। কে দীক্ষিত আর কেই বা অদীক্ষিত সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হল ধর্মের মূল শিক্ষাটা মানুষ আত্মস্থ করতে পারছে কিনা? শিকাগো বক্তৃতার ১২৫বছর নিয়েও রাজনীতি শুরু করেছেন রন্তিরা। নানা কলকাঠি নেড়ে আটকে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর শিকাগো সফর। মিশন এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আরএসএস-এর লোকজন যেভাবে গাল পাড়ছেন তাতে মনে হচ্ছে ধর্মের মূল শিক্ষাটাই তারা বুঝতে পারেন নি।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
অশোক মজুমদার
লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রথিতযশা চিত্র সাংবাদিক