বিশ্বকর্মা পুজোর দিন-ভোকাট্টা,মাচা গান, আকাশ জোড়া ঘুড়ি, চাইনিজ মাঞ্জা, মন্ডপের সামনে কর্মঠ মাতাল ছাড়াও কিছু ভূত দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বকর্মা ভূত।
সাধারণ মানুষ যারা সেদিন রিক্সাওয়ালা চারগুন ভাড়া চাইছে বলে খিস্তি করে, শপিং মলে মিনারেল ওয়াটারে রাম ফুচকা খেয়ে বমি করে, বিকট জোরে গানওলা ডিস্কে যায় গলা অব্দি মদ খেতে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ভাসানের নাচ নাচতে, তারা ওই ভূত দেখতে পারেনা।
এই ভূত গুলো ঘুরে বেড়ায় ঊষা কারখানার সাইরেনের চারপাশে। এখন যে জমিতে সাউথ সিটির সবচেয়ে উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িটার সবচেয়ে উঁচু ছাদ উঠেছে। কিংবা বাটা কারখানার গেটে। যেখানে এখন বহুতল আবাসন। ভূত বসত করে হাওড়া, হুগলি, নৈহাটি, ব্যারাকপুর চত্বরে। চটকলে, মেটালিকে, ইঞ্জিনিয়ারিং নাম শুনলেই।
ঝুপ করে ঢুকে পরে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্টাফ কোয়াটারে। দয়াল বিশ্বকর্মা যে ঘরটায় গলায় দড়ি দিয়েছিল। কিংবা নর্থব্রুকের ওই অফিস ঘরটার সামনে যেখানে পিটিয়ে মারা হয়েছিল ম্যানেজার হরেকৃষ্ণ মাহেশ্বরীকে। অথবা ডুয়ার্স চা বাগানে। হাড় গিলগিলে, গা ছমছমে। একটু সাদা ভাত নুন দিয়ে পেলে কামড়া কামড়ি করে খাবে।
প্রতি দুর্গা পুজোর আগে লকআউট হয়ে যেত কারখানা, একদিন তালা মেরে দিল সাহেব। কেউ চাকরি করে না, কেউ না। বাড়িতে ২৩ বছরের মেয়েটা একদিন বোম্বে পালালো এক দালালকে বিয়ে করে। টাকা পাঠাতো প্রথম প্রথম, তারপর বন্ধ। বিশ্বকর্মা ভূত হতে গেলে প্রথমে হতে হয় টিবি। তাই হল। তারপর চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা, অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য না করতে না পেরে একদিন অপঘাতে মৃত্যু।
বিশ্বকর্মা শৌখিন বাঙালির অরুচি। তার ওপর আবার ভূত। কোন ইতিহাস বই, নিষিদ্ধ ইস্তেহার, সরকারি গেজেটে এদের উল্লেখ নেই। থাকার মধ্যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ, চপ শিল্প, শ্রমিক অসন্তোষ, ভিনদেশে কাজের খোঁজে পাড়ি।
বিশ্বকর্মা ভূতেরা অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ন্যানো কারখানা, জুটমিল, ভারি শিল্প ছিল যা কিছু তার আশেপাশে খালি পায়চারি করছে। কোন বৃদ্ধি নেই, কোন বৃদ্ধি নেই ফিসফিস করছে। কচু শুনছে কেউ। রাজারহাটের আইটি শিল্প ব্যস্ত গণেশ পুজো নিয়ে, সরকারবাহাদুর ভাতা-উৎসবে। বন্ধ কারখানায় নজর দেবে কে?
বাঁচাকুচা বিশ্বকর্মারা ভূত হয়ে যাবার আগে গোটা রাস্তা তে আজ ঢেঁকুরের আওয়াজ করবে। রেপ্সিড তেলে ভাজা আর সস্তার মদ খালি পেটে খেলে যে ঢেঁকুর ওঠে। সাথে পেঁয়াজ রসুন গন্ধ ম ম করবে হরিজন বস্তির হেঁসেলে। বিশ্বকর্মা ঠাকুর আর ওসির বোতল নিয়ে বান্টু সেল্ফি নেবে কোন নেতার অনুপ্রেরণায় তৈরি হওয়া রাস্তায়। আজ ও দারুণ হ্যাপি উইথ ৪৯ আদার। তেলের চেয়ে সস্তা মোবাইল ডেটা, তারচেয়ে ও সস্তা ফোর জি সিম। দে ঠুকে ফেবু লাইভ।
এরপর লাচ হবে রাস্তা জুড়ে। মাঝে কম্পালসারি ফেটে যেতে হবে থানার মেজো বাবু চক্কর মারতে এলে। ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে রাতে মাইক বাজালে অভিযোগ জমা পরে লোকাল থানায়। ওসব ফ্ল্যাট বাবুদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে আমাদের পাগলু গান শুনলে৷ বাবুরা ইস্ত্রি করা জামা, ধবধবে হোয়াইট কলার পড়ে এসি ঘরে লেবারগিরি করে আর মাথা ঠোকে গনেশে মার্চ মাসের ইনক্রিমেন্টের আগে। ওদের রাস্তাজুড়ে ঝলমল করে এলইডি বিজ্ঞাপন। বিশ্বকর্মা ভূতের গল্প ওদের টাইমলাইনে টোকা মারে না। ওরা ল্যাংচা হাব নিয়ে খুশি।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )
ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
লেখক প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক