কলকাতার বড় বড় হাইপ্রোফাইল দুর্গাপুজোর মধ্যে একটি শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। প্রতিবারই পুজো শুরুর দিন দুয়েক আগে থেকেই শ্রীভূমির মণ্ডপ দেখার জন্য ভিড় করেন শহরবাসী। বেশ কয়েকবছর ধরেই পুজোর থিমে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে শ্রীভূমি স্পোর্টিং- এর উদ্যোক্তারা। বছরের প্রথম থেকেই থেকেই তার প্রস্তুত শুরু হয়ে যায়। এবারেও নতুন কিছু চমক নিয়ে হাজির হচ্ছে শ্রীভূমি। এবার তাদের কল্যাণেই গোটা লেকটাউন জুড়ে শরতের আগমনী বার্তায় ইতিহাসের গন্ধ। এ বছর এখানে মণ্ডপসজ্জার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ঐতিহাসিক চিতোরের দুর্গকে। গত বছর তারা জনপ্রিয় সিনেমা বাহুবলী টু-কে থিম করেই গড়ে তুলেছিল মণ্ডপসজ্জা। আর এবারের থিম হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছে সঞ্জয়লীলা বনশালীর বিতর্কিত সিনেমা ‘পদ্মাবত’-এর সেই ঐতিহাসিক সেট। শুধু রাজস্থানী ঘরানার মণ্ডপসজ্জা নয়, আলোকসজ্জাতেও থাকবে রানি পদ্মাবতীর স্পর্শমাখা সেই রাজপ্রাসাদ। ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার লোহার কাঠামো, হাতে আঁকা ছবি, প্লাইউডের মাধ্যমে গড়ে উঠছে সুফি কবি মহম্মদ জয়সীর বর্ণনায় থাকা সেই চিতোর প্রাসাদ। রাজপুত-সুলতানদের কাহিনীর ঘনঘটা যাতে মণ্ডপে ঢুকলেই পরখ করা যায়, চলছে তার প্রস্তুতি। মূর্তিতে থাকছে সাবেকিয়ানা। তবে চমক থাকছে গণেশকে ঘিরে। হাতির পিঠে গণেশের আবির্ভাব। যেখানে কার্তিক হবেন ঘোড়সওয়ার। দেবদেবীর সব গয়নাই সোনার। ফিরোজাবাদ থেকে আসছে ১৫১টি বিশেষ ঝাড়বাতি। মণ্ডপের বাইরে ছোট ছোট আলোকমালায় ফুটে উঠবে পাখি, ফুল, হ্যামলিনের বাঁশি, জাদুর নানা ঘটনা।
এই সিনেমার মুক্তি পাওয়া নিয়ে আসমুদ্র হিমাচলে বিতর্কের ঢেউ উঠেছিল। কর্নি সেনা-হিন্দু ধ্বজাধারীদের হুমকির মুখে পড়ে, একাধিক রাজ্যে এই সিনেমার মুক্তির উপর জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। সেই অবস্থায় দেশের সংস্কৃতির পীঠস্থান এই বাংলায় পদ্মাবত সিনেমা মুক্তিতে সবরকম সাহায্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব শারদোৎসব কমিটির সভাপতি বিধায়ক সুজিত বসু জানালেন, এই ইতিহাস নির্ভর, বাণিজ্য সফল সিনেমাকে ঘিরে আগুন জ্বালানো হয়েছিল। চলচ্চিত্রের মুক্তিতে বাধা দিয়ে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সব হেলায় উড়িয়ে এ রাজ্যে পদ্মাবত সিনেমা সুষ্ঠুভাবে মুক্তি পেয়েছিল। আমরা সেই ঐতিহাসিক সিনেমার মূল ক্ষেত্রভূমি চিতোরের রাজপ্রাসাদকে এবার মানুষের সামনে তুলে ধরছি, সুস্থ সংস্কৃতির বার্তা দিচ্ছি। গতবার বাহুবলীর সেটে রেকর্ড ভিড় হয়েছিল। আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছিল। আমি নিশ্চিত, ভিড়ের সেই রেকর্ড ভাঙবে পদ্মাবতের কাঠামো।
টানা দু’মাস ধরে চলছে নিরন্তর যুদ্ধ। প্রায় ৪০ জন মণ্ডপশিল্পী দিনরাত মগ্ন সাধকের মতো একের পর এক কাঠামো জুড়ে গেঁথে চলেছেন এক ঐতিহাসিক গাঁথা। পদ্মাবতের প্রাসাদের আদলে মন্ডপ তৈরির জন্য মূলত কাচ, ফাইবার, প্ল্যাস্টিক, বিভিন্ন রঙের সুতো-সহ আরও নানা সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁদের কাজের তদারকি করছেন মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে থাকা শিল্পী, রোমিও। আছেন চন্দননগরের বিখ্যাত আলোকশিল্পী বাবু পালও। এই আলোকশিল্পী জানান, আশাকরি আমার অতীতের সেরা কাজগুলিকেও ছাপিয়ে যাবে এবারের আলোকসজ্জা। এলইডি’র সূক্ষ্ম শিল্পের কাজ তো থাকবেই, তার সঙ্গে থাকবে সাবেকি টুনির আলোকমালা। যাতে বৈচিত্র্যেভরা আলোকসজ্জা উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা। থাকছে ২৭ ফুট উচ্চতার দুটি ট্যাবলো। ভিআইপি রোডে অনেকগুলি বড় বড় গেট করা হচ্ছে। ভিআইপি রোডে ডিভাইডার সাজছে আলোর প্যানেলে। মণ্ডপের বাইরে ইলেকট্রিকের দায়িত্বে আছেন বাপন দাস। প্রাসাদে শব্দের আবহ গড়ে তুলবেন টিঙ্কু হালদার, অমল দাস। মূর্তি গড়ছেন প্রদীপ রুদ্রপাল। সুজিতবাবু জানান, পুজোর উদ্বোধনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। তিনি যেদিন সময় দেবেন, সেদিনই হবে উদ্বোধন। পুজোর আগেই খুলে যাবে ভিআইপি রোড সংলগ্ন দুটি নতুন সাবওয়ে। পুজো উপলক্ষে সম্প্রতি এশিয়াডে পদক জয়ীদের আনা হবে মণ্ডপে। বস্ত্র বিতরণ, অষ্টমীতে হাজার-হাজার মানুষকে ভোগ বিতরণ—এসব তো থাকবেই। গতবার শ্রীভূমির বাজেট ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। আর এবার পদ্মাবতের রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলতে বাজেট বাড়িয়ে করা হচ্ছে প্রায় ২ কোটি টাকা।