টুকটুকে ফরসা রং, ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুলগুলো একদম পরিপাটি করে আঁচড়ানো।জামা প্যান্টের সঙ্গে বেল্ট, জুতো এমনি কি ঘড়ি আর চশমার ফ্রেমটা পর্যন্ত ম্যাচিং।বুক পকেট থেকে গোল্ডেন কালারের একটা দামি পেনের মাথা উঁকি মারছে আর গা থেকে ডুরভুর করে বেরচ্ছে পার্কএভিনিউ সেন্টের গন্ধ, স্মিত হাসি মাখানো মুখ, হাঁটার মধ্যেও একটা যেন স্টাইল আছে।”সিনেমার নায়ক না স্কুলের শিক্ষক? ওনাকে প্রথম দেখার পর আমার ঠিক এই কথাটাই মনে হয়েছিল।প্রথম দর্শনটা দৃষ্টি সুখের হলেও প্রথম ইন্টার্যা কশন মোটেই সুখকর হয়নি আমার। সিক্স বি, স্বপন বাবুর প্রথম ক্লাস, এলজেবরা…..তিক্ত স্মৃতিটা এখনও উজ্জ্বল।প্রবোধ বাবু কয়েক দিন আগে এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার, এ মাইনাস বি হোল স্কোয়ার ইত্যাদির ফর্মুলা শিখিয়ে গেছিলেন। সেগুলোকেই ঝালিয়ে নিতে নিতে স্বপন বাবুর প্রশ্নটা হঠাৎ আমারই দিকে ছুটে আসল..”এই যে সাদা ইঁদুর এবি র ফর্মুলাটা বল দেখি”…..ডান দিক বাঁ দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মুখে “আমি????” এই অবাক করা এক্সপ্রেশন টা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, এবি র ফর্মুলা..নাহ্ কোনো দিন শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না…ডান হাতটা কখন যে মাথাটা চুলকাতে শুরু করছে কে জানে ..প্রায় এক মিনিট সুযোগ দেবার পর ডায়াস থেকে চিৎকারটা ভেসে আসল.”বুঝেছি তোর দ্বারা হবে না…..দাড়িয়ে থাক কান ধরে হতভাগা…..বাঁদর কোথাকারের।” সাদা ইঁদুর আর বাঁদর দুটোর একটাও পছন্দসই নাম নয় একদমই….মুখ কাঁচুমাচু করে সারাটা পিরিয়ড দাঁড়িয়ে রইলাম কান ধরে।
সেই শুরু,।তারপর থেকে স্কুলে আমার ছাত্র জীবনের শেষ দিন, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টটা হাতে পাওয়া পর্যন্ত ওনার সাথে আমার সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকের মতো মধুর হয়নি।বরাবর দু-জনের মধ্যে একটা দূরত্ব, তিক্ততা বজায় ছিল।আমাকে সাদা ইঁদুর নামটা তো দিয়েছিলেনই উপরন্তু ওনার মতে, সব স্যারের কাছেই মাছের বাজারে বলে পরিচিত ক্লাসটাতে সবচেয়ে হাঁকিয়ে মাছওয়ালাটা ও নাকি আমিই ছিলাম।যদিও পরবর্তী কালে কর্মক্ষেত্রে এই সব “মাছওয়ালা” দের গরিষ্ঠ অংশই দেশে বিদেশে নিজেদের হীরে মুক্ত জহরৎ হিসেবে প্রমানিত করেছে যা বোধহয় সব স্কুলের ক্ষেত্রেই হয়। আর এই সব মাছওয়ালা, ঘোড়া, গাধা গুলোকে পিটিয়ে মানুষ করার জন্য আমাদের স্যারেরা সারা জীবন অক্লান্ত খাটুনি খেটে গেছেন।
স্কুলের অধিকাংশ স্যারের জন্যেই নির্দিষ্ট কিছু নাম বরাদ্দ ছিল ছাত্র মহলে, তাঁদেরকে নিয়ে আড়ালে আলোচনার জন্য …এই যেমন শতদল বাবুকে পদ্মফুল, বিমলবাবুকে ‘ওনলি বিমল’ ইত্যাদি ইত্যাদি।আমার খুব অবাক লাগত আবার রাগও হত স্বপন বাবুর ঐ রকম কোনো নিক্ নেম না থাকার জন্য। ক্লাসে কঠিন কোন প্রশ্ন করার জন্য ফার্স্ট সেকেন্ড বয়দের বাদ দিয়ে উনি যে কেন আমাকেই খুঁজে পেতেন তা বোধ ভগবান আর উনিই জানতেন। যথারীতি আমি পারতাম না এবং আমার কপালে জুটতো কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো, ব্ল্যাক বোর্ডের পাশে নীল ডাউন হওয়া ইত্যাদি শাস্তিগুলো অথবা “একদম গবেট, মাথায় কি আছে তোর? “….অঙ্কে তুই এবার সিওর ফেল”….এই ধরনের কান গরম করা কথাবার্তা। লাস্ট বেঞ্চ, লাস্ট বেঞ্চের একদম কর্নারের সিট….এত কিছু করার পরও স্যারের চোখ কি করে যেন ঠিক আমাকে খুঁজে পেত বোর্ডে একটা বিদঘুটে অঙ্ক কষার জন্য। রুটিনে স্বপনবাবুর ক্লাস থাকলেই গায়ে জ্বর আসত আমার। মাঝে মাঝে রাগও হত খুব একবার তো ক্লাস এইট না নাইনে বলেই দিয়েছিলাম “স্যার, আপনি কেন আমাকেই এই কঠিন প্রশ্ন গুলো করেন? আমার তো মনে হয় এর উত্তর ক্লাসের ফার্স্ট বয়ও দিতে পারবে না।”এর জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। হেডস্যারের ঘরে গার্জিয়ান কল হয়েছিল আমার।কেন জানি না স্যার আমার কোনো সাফল্যকেই অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারতেন না।ফুটবলটা ভালোই খেলতাম। হয়তো মাঠে ইন্টার লিগের কোনো ম্যাচ চলছে, অন্যান্য স্যার দের সঙ্গে স্বপন বাবুও খেলা দেখছেন।আমি বেশ ভালো খেলেছি। বন্ধুরাতো বটেই স্যারেরাও বাহবা দিচ্ছেন খেলার শেষে। হঠাৎ পাশ থেকে স্বপন বাবুর গলা…“ঐ বাঁশকাঠি চেহারায় ফুটবল খেলা বেশি দূর এগোবে না”।…কার না শুনে রাগ হয়। বিজয়া দশমীর পর সবাই স্যারকে প্রণাম করছে দেখা দেখি আমিও গেছি, কোমরটা সবে পায়ের সামনে ঝুঁকিয়েছি” থাক থাক আর প্রণাম করতে হবে না, একটু ভদ্র সভ্য মানুষ হলেই চলবে”…আমার জন্য এটাই স্বপন বাবুর আশীর্বাদ। এর পর আর কারো ভক্তি থাকে? তবে লক্ষনীয় বিষয় ছিল এটাই এত তিক্ততার মধ্যেও স্যার কিন্তু আমার খবর রাখতেন, হয়তো অ্যানুয়াল বাংলায় হায়েস্ট পেয়েছি, করিডোরে পাকড়াও করেছেন আমাকে” কিরে শুনলাম বাংলায় নাকি আটাত্তর পেয়েছিস….অঙ্কে তো বোধহয় পঞ্চাশ ও হয়নি”।যদিও আমি পেয়েছি বাষট্টি। স্কুল ম্যাগাজিনে আমার আঁকা বেড়িয়েছে, সবাই প্রশংসা করছে….স্বপন বাবু ছবি দেখে বিরস মুখে জানালেন কালার কম্বিনেশন নাকি ঠিক মত হয় নি।সময় থেমে থাকে না। যাই হোক এই ভাবে চলতে চলতে একদিন মাধ্যমিকটা পাশ করে ফেললাম আর মোটামোটামুটি ভদ্রস্থ নম্বর পেয়ে স্কুলে সায়েন্স পড়ার সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু আবার সেই স্বপন বাবু। এবার ক্যালকুলাস।
প্রথম দিন ক্লাস করাতে এসেই আমাকে বলে দিলেন….”মাধ্যমিকটা উতরে গেলেও উচ্চমাধ্যমিকে পাশ করতে পারবি বলে মনে হয় না।আমার সাবজেক্টে তো নয়ই।”তবে এ কথা একদম সত্যি যে ইলেভেনে উঠে আমার পাখনা গজিয়ে ছিল। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অন্যান্য ব্যাপার গুলোতে বেশি মনোনিবেশ করে ফেলেছিলাম।তার প্রতিফলন ঘটে ছিল ক্লাস ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার রেজাল্টে।টুয়েলভে উঠেও নিজেকে শোধরাতে পারিনি।কেন পারি নি, যদি কোনও দিন সুযোগ হয় বলব।টেস্টের পর শুধু স্বপন বাবু নন অন্যান্য স্যারেরাও সাবধান করেছিলেন। “এবার একটু পড়াশোনা কর না হলে কিন্তু মুশকিল আছে।”যাই হোক সবার সাবধান বাণী শুনতে শুনতে পরীক্ষা টা নম নম করে দিয়েই ফেললাম। আর দেখতে দখতে উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টের দিনটাও এসে গেল। জানতাম ভালো হবে না। পড়াশোনাই তো করি নি ভালো করে…সব কিছু তো আর স্টেজে মারা যায় না….যাই হোক মার্কশিট যখন হাতে পেলাম দেখলাম যা আশা করেছিলাম পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ…..একটু দূরে বন্ধুরা সব ভীড় করে রেজাল্ট নিয়ে আনন্দ করছে, টিচার্স রুমের বাইরে একটা ছোটখাটো জটলা, স্যাররা সবাই বাইরে সবার মার্কশিট চেক করছেন। ছাত্র শিক্ষক সবার মুখেই চওড়া হাসি….সাফল্যের হাসি।শুধু আমি একা দাঁড়িয়ে। একদম একা অন্ধকারে।……একটা হাত এসে কাঁধের উপর পড়ল। চমকে তাকালাম।…স্বপন বাবু আমার পিছনে দাঁড়িয়ে।..”দেখি তোর রেজাল্টটা”…অবাক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে স্যারের হাতে তুলে দিলাম আমার মার্কশিট।পুরো রেজাল্টটা অনেক ক্ষণ ধরে দেখে তাকালেন আমার দিকে….”কষ্ট হচ্ছে?…মন খারাপ লাগছে খুব, সহ্য কর…এই কষ্টটা তোকে সহ্য করতে হবে….তুই না স্পোর্টস ম্যান…এত সহজে হেরে যাবি?… সবে তো শুরু রে…জীবনে এর থেকেও অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তোকে…এত সহজে হেরে গেলে চলবে না অরিন্দম”।সেই প্রথম ওনার মুখে নিজের আসল নামটা শুনেছিলাম। মুখে সেই স্মিত হাসি নিয়ে আর একটা কথাও বলেছিলেন স্যার, যা আজও কানে বাজে….”মনে রাখবি প্রতেকটি সাফল্যের পিছনেই একটা করে ব্যর্থতা আছে…সাফল্য আর ব্যার্থতা নিয়েই তো জীবন রে।….হ্যাঁ আর একটা কথা। সব সময়ে চেষ্টা করবি প্রকৃত মানুষ হওয়ার।”
সেই দিন প্রথম মন থেকে স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রমাণ করেছিলাম। স্যারও আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন অনেকক্ষণ। না কোনও সেন্টের নয় পরম আত্মীয়তার গন্ধ পেয়েছিলাম সেদিন স্যারের গা থেকে।
সেই শেষ। আর কোনো দিনও দেখা হয়নি স্বপনবাবুর সঙ্গে….এক বছর আগে স্যার চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে। বড্ড তাড়াতাড়ি।আমি এখনও স্যারের শেষ কথাটা পালন করার চেষ্টা করে চলেছি।….মানুষ হবার চেষ্টা।….বড্ড কঠিন সে কাজ।