শিকাগোর বিশ্ব হিন্দু কংগ্রেসে গিয়ে মোহন ভাগবত, দিলীপ আমিনরা যেসব বাণী বিতরণ করছেন তা শুনে লোকজন মহা ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন। শিকাগো বক্তৃতার ১২৫বছরে পৌঁছে এ কাদের খপ্পরে পড়লেন বিবেকানন্দ! এই সেই আমেরিকার শিকাগো শহর। এখানকার আর্ট ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ধর্ম মহাসন্মেলনে আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশি শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন মানুষে মানুষে ভালোবাসার মন্ত্র। বক্তৃতার শুরুতেই উপস্থিত শ্রোতাদের সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা বলে নিমেষে আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। গোটা হল জুড়ে বয়ে গিয়েছিল করতালির ঝড়। সৌম্য দর্শন এই ভারতীয় সন্ন্যাসীকে মানুষ পাগলের মত ছুঁতে চেয়েছিল। আমাদের দেশের প্রকৃত আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে বিদেশি শ্রোতাদের কাছে সহজভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। ভারতকে নতুনভাবে চিনিয়েছিলেন। বক্তৃতার শেষে তিনি বলেছিলেন, আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি, আজ এই ধর্ম মহাসন্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সন্মান জানাতে যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হল, তা ধর্ম নিয়ে উন্মত্ততার, তরোয়াল বা কলম দিয়ে করা যাবতীয় নির্যাতনের এবং অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ভাইদের পথে যাবতীয় বাধার মৃত্যুর ঘোষণা করবে। আবার বিপুল হাততালিতে ভেসে গেল হল।
ধর্ম মহাসন্মেলনের ১২৫বছর পূর্তিতে শিকাগোয় গিয়ে বিজেপির পণ্ডিতরা যেসব প্রলাপ বকছেন তাতে মনে হচ্ছে বাঁদররা যেন ডারউইনের বিচার করছেন। তারা এই সন্মেলনের মূল সুরটাই ধরতে পারেন নি। অবশ্য পারার কথাও নয়। ধর্মে ধর্মে বিভেদ বাধিয়ে যারা ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে চান তারা তা বুঝবেন কী করে! বেলা ১০টায় যে ঘন্টাটি দশবার বাজিয়ে এই মহাসন্মেলন শুরু হয়েছিল সেই ঘন্টার গায়ে লেখা ছিল, তোমাদের কাছে আমার নব নির্দেশ পরস্পরকে ভালবাসো। বিশ্বের কাছে এই ভালবাসার বার্তা দিতেই ধর্ম মহাসন্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্ম, ইহুদি, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, তাও, কনফুসিয়াস, শিন্টো, জরথ্রুস্ট এবং খ্রিস্টান এই দশটি ধর্মের প্রতিনিধিরা। সব ধর্মকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতেই প্রতিটি ধর্মের জন্য একটি করে ঘন্টা বেজেছিল। আজকে যারা ধর্ম মহাসন্মেলন নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন তারা তো এই বহুত্বের বন্দনাকে স্বীকারই করেন না। বিজেপির রাজনীতি তো আদতে এই সহনশীলতার বিরুদ্ধেই এক ঘোষিত যুদ্ধ। শিকাগোয় গিয়েও তারা ভালবাসার বদলে সেই ঘৃণার রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি করছে। স্বামীজি দিয়েছিলেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে এক হওয়ার ডাক, এই শিকাগোতেই ভারতের জাতিভেদ প্রথার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তিনি। আর মোহন ভাগবতরা দিচ্ছেন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিন্দুদের এক হওয়ার ডাক। চাইছেন ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করতে। বোঝো ব্যাপারখানা!
রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক সম্প্রীতি সবক্ষেত্রে বিজেপি যতই নিজেদের কৃতকর্মের ফলে ল্যাজেগোবরে হচ্ছে ততই নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চাইছেন তারা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর উস্কানি দিচ্ছেন। এবার তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্করা পরেছেন প্রয়াত পতৌদি এবং শর্মিলার বিয়ে নিয়ে। তাদের কাছে এটাও নাকি লাভ জেহাদ। হিন্দু সমাজের জনসংখ্যা কমানোর একটা পরিকল্পিত কর্মসূচি। খুব ভেবেচিন্তেই হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তকরণের জন্যই একাজ করা হচ্ছে। কার ছেলের কি নামকরণ হবে, কার ছেলে বা মেয়ে কাকে বিয়ে করবে এসব ব্যাপারেও তালিবানি ফতোয়া জারি করছেন তারা। দেউলিয়া রাজনীতির কী করুণ পরিণতি! নিজেদের যারা সিংহর সঙ্গে তুলনা করেন, তারা অন্যের ঘরে ছুঁচোর মত উঁকি দেন কেন তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা!
একটা ব্যাপারে আমার প্রথম থেকেই একটা সন্দেহ ছিল। শিকাগোতে গিয়ে আর এস এস-এর লোকজনদের কাজকর্ম সেই সন্দেহটাতে সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছে। তা হল, দিদির শিকাগো সফর রাতারাতি বাতিল হল কেন? আমার মনে হয়, মোহন ভাগবতদের আগে গিয়ে যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশে বিজেপির ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করেন তাহলে তাদের ব্র্যান্ড বিল্ডিং এক্সারসাইজটাই মার খাবে। সেখানকার মানুষ ভারতের ধর্ম নিয়ে বিজেপির ব্যাখ্যাকে আর মোটেই আমল দেবেন না। সেই জন্যই তার সফর রাতারাতি বাতিল করা হল। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। বিজেপির অবস্থাটা হয়েছে ঠিক সেরকম। তারা নিজেরাই এত ভুলভাল কথাবার্তা বলছেন যে, লোকে তা আর মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নিজেদের মুখোশ তারা নিজেরাই খুলছেন।
শিকাগো বক্তৃতার ১২৫বছরে আমাদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। তা হল, বিজেপির ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতার রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া। জোর গলায় বলা শিকাগো বক্তৃতা নিয়ে কোন কথা বলার অধিকার তোমাদের নেই। কারণ, তোমাদের রাজনীতি বিবেকানন্দের আদর্শের একেবারে বিরোধী। তাঁর কোন কথাই তোমরা মানো না। ধর্ম মহাসন্মেলনের মূল আদর্শেরই তোমরা বিরোধী। যে কর্মযোগের আদর্শে স্বামীজি বিশ্বাসী ছিলেন তা বিজেপি মানে না। তাদের কর্মযোগ হচ্ছে, ডিমনিটাইজেশনের নামে গরীবকে নিঃস্ব করে দেওয়া, ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা লাগানো, দেশের সম্পদ বাড়ানোর বদলে নীরব মোদী মেহুল চোকসির মত ঠগদের দেশের টাকা লুঠ করে বাইরে পালাতে সাহায্য করা। মানুষকে সেবা করা, আশ্রয় দেওয়ার বদলে তাদের অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা – এদের কুকর্মের নমুনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাই সেই চেষ্টা আর করছি না। ২০১৯এর কথা মাথায় রেখে দেশজুড়ে হিন্দু ভোট সংহত করার লক্ষ্যেই বিজেপির এই পরিকল্পনা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসন, উন্নয়ন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হওয়ার পর ধর্মের জিগির তুলে হাঙ্গামা বাধানো ছাড়া তাদের হাতে আর কোন অস্ত্র নেই। আসলে এরা হিন্দু, মুসলমান কাউকেই ভালবাসেন না। তাদের তাত্ত্বিক নেতারা তাই নিজেদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব ঢাকতে বিবেকানন্দকে সামনে আনছেন। কিন্তু মানুষ তাদের এই খেলা ধরে ফেলেছেন। ১৯এর ভোটেই বিজেপি একথা বুঝতে পারবে।
প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধর্ম আছে। নিজের ধর্মে ধীর থেকে সেই বিশ্বাসকে সন্মান করতে শিখতে হবে। আর বিজেপির মত কুকর্ম নয়, সুকর্মে বীর হতে হবে আমাদের। এটাই মানবধর্ম, এটাই স্বামীজির শিক্ষা। ধর্ম মহাসন্মেলনের মূল শিক্ষাকে তবেই আমরা আমাদের জীবনে নিয়ে আসতে পারবো।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )