গত আগস্ট মাসের ১৮-২০ ভারত সরকার পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ রাষ্ট্র, মরিশাসে “ওয়র্ল্ড হিন্দী কনফারেন্স” কিংবা বিশ্ব হিন্দী অধিবেশন আয়োজন করল। এই অধিবেশনের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দী ভাষার সম্প্রসারণ। এবং বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারত সরকার হিন্দীকে ইউনাইটেড নেশনের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ করার চেষ্টাও করছে এবং তার জন্য প্রতি বছর পিছু কোটি কোটি টাকা দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু হিন্দী ভাষা কেন? ভারতে তো ২২টা অফিসিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ আছে হিন্দী তার মধ্যে একটি। ভারত সরকার আর ২১টি ভাষার জন্য এমন কিছু করছে কি? তেমন কোনো খবর তো আমার জানা নেই।
এই অধিবেশন চলাকালীন ভারতের বিদেশ মন্ত্রী মাননীয়া সুষমা স্বরাজ বললেন ” ভাষার গৌরবের সাথে সাথে সংস্কৃতির গৌরব খুব প্রয়োজন। কিন্তু ভাষা যখন লুপ্ত হতে থাকে, সংকৃতির লুপ্ত হওয়ার বীজও ওইদিনই বপন হয়ে যায়”। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন কি ঘটল যার থেকে মনে হচ্ছে শুধু হিন্দী ভাষা অবলুপ্তির পথে? আর ভারতের আর ২১টি ভাষা অত্যন্ত সুরক্ষিত, তাদের সম্প্রসারণের কিংবা সমৃদ্ধির জন্য এই রকম কোনো সরকারি মদতের প্রয়োজন নেই ? ভারতের মতো বহুভাষিক রাষ্ট্রে কি ভাবে সরকার এতগুলো ভাষার মধ্যে একটি ভাষার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারে ? এটা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-হিন্দী ভাষী ভারতীয় নাগরিকদের প্রতি বঞ্চনা নয় ?
সংবিধান অনুযায়ী হিন্দী এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম চলে। যদিও এই কাজ কর্মের মধ্যে সরকারের জনগণকে তথ্য কিংবা পরিষেবা প্রদান পড়ে না। এই কাজকর্মেরও আবার কিছু নিয়ম আছে। যেমন ক্যাটাগরি সি স্টেটের সাথে মানে মূলত অ-হিন্দী রাজ্যের সাথে সব সময় ইংরেজী বাক্যালাপ করতে হবে। এর বেশি সংবিধান হিন্দীকে অন্য ভাষার তুলনায় কোনও আলাদা স্থান দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে থেকে বারবার আমরা দেখেছি কেন্দ্রীয় সরকার ছলে, বলে, কৌশলে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে হিন্দী ভারতের একমাত্র ভাষা।
আজ ভারতের মতো এক বহুভাষিক রাষ্ট্র সারা পৃথিবীর চোখে হয়ে উঠেছে এক হিন্দীভাষী রাষ্ট্র। ভারতের ভাষা বলতে হিন্দী আর সিনেমা বলতে বলিউড এই জগৎ বোঝে। হিন্দী ভাষা, সংস্কৃতি যেমন ভারতের ঠিক তেমনি আরো অসংখ্য ভাষা ও সংস্কৃতি ভারতের একদম নিজের যাকে বাদ দিয়ে ভারত ভাবা যায়না। কিন্তু ভারত সরকারের এই বিমাতৃসুলভ আচরণ সেই বহুভাষিক রাষ্ট্রের স্বরূপ আজ পাল্টে দিচ্ছে। অন্য সকল ভাষাকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট উদাহরণ টেনে আনা যায়। তা হলো ভারতীয় পাসপোর্ট। প্রথমে বলি ভারতীয় পাসপোর্টে “হিন্দী” আর “ইংরেজী” ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহৃত হয় না। এবার দেখা যাক পৃথিবীর নানান দেশে কি প্রথা আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টে ৩টি ভাষা আছে, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ। ১৯৯০ সালে তারা স্প্যানিশ ভাষাকে পাসপোর্টের ভাষা হিসেবে যুক্ত করে। কারন পুওর্তো রিকো বলে একটি ছোট্ট দ্বীপের প্রধান ভাষা হল স্প্যানিশ। এই দ্বীপটির জনসংখ্যা হল ৩৪ লক্ষ আর তাদের প্রধান ভাষা হল স্প্যানিশ। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে পুওর্তো রিকো কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্ত হয়। আমেরিকার যে ৫০টি রাজ্য আছে তার মধ্যে কিন্তু পুওর্তো রিকো পড়েনা। এখানকার লোকেদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটাধিকার নেই, সেনেটে কোনো প্রতিনিধি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা হল ৩০.৮ কোটির কিছু বেশি। কিন্তু এই ছোট্ট দ্বীপ যার নাগরিক মোটে ৩৪ লক্ষ তার ভাষাকে আমেরিকার সরকার পাসপোর্টে মান্যতা দিয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। এই দেশে তামিলদের ওপর তাদের সরকার নানা অত্যাচ্যার করে এসছে বহু যুগ ধরে। তামিলদের ওখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রেখেছে। তাই সেখানে বহু আন্দোলন, বহু রক্ত ঝরেছে শ্রীলঙ্কা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে। কিন্তু মজার ব্যাপার সেই দেশের সরকার তাদের পাসপোর্টে তামিল ভাষা কে মান্যতা দিয়েছে।
আর একটা দেশকে উল্লেখ করা উচিত, পাকিস্তান। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র কিন্তু পাসপোর্টে বাংলাকে মান্যতা দিয়েছিল কারণ তাদের দেশের একটা বড় জনসংখ্যা বাংলা ভাষায় কথা বলতো। মনে রাখতে হবে পাকিস্তান হল সেই দেশ যেখানে বাঙালিদের ভাষার নিরিখে সমান অধিকার চাওয়ার সাজা হিসেবে ৩০ লক্ষর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
তাই আজ একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে। ভারতবর্ষের মতো রাষ্টে যেখানে ২০০১ এর সেনসাস রিপোর্ট বলছে ৭৫% মানুষের অ-হিন্দী মাতৃভাষা, সেখানে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অহিন্দী ভাষীর অবস্থা কি পুওর্তো রিকোর ৩৪ লক্ষ স্প্যানিশ, শ্রীলঙ্কার তামিল কিংবা পাকিস্তানের সেই যুগের বাঙালিদের থেকেও বেশি খারাপ?
একটি ভারতের মতো বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক রাষ্ট এক ভাষা ও এক সংস্কৃতিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক সেটা কখনই কাম্য নয়। ভাষার প্রশ্ন কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্ন, বড়লোক-গরিবলোকের প্রশ্ন। যখন কোনো ভাষার অবলুপ্তি ঘটে তখন সবচেয়ে সমস্যায় পড়েন সাধারণ মানুষ। কারণ মানুষ প্রথমে শেখে মাতৃভাষা তারপর অন্য কিছু। যার অন্য কোনো ভাষা শেখার উপায় নেই, তার কাছে মাতৃভাষাই একমাত্র সম্বল। মাতৃভাষায় যখন কোপ পরে তখন সেটা আসলে তার পেটে কোপ পরে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে গৌণ করে কোনো রাষ্টের উন্নতি আজ পর্যন্ত হয়নি। ভারত যদি এক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে দেখতে চায় তার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হলো সর্ব ধর্ম, সর্ব শ্রেণী, সর্ব ভাষী, সর্ব জাতির মানুষকে সর্ব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেওয়া। এটা যদি আমরা না করতে পারি ভারত আর ভারত থাকল না।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )