৩১শে মার্চ, ২০১৬। সেই কালো দিনটা এখনও মনে আছে। বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার তুঙ্গে, সকালে সবে অফিস ঢুকেছি। কিছুক্ষণ পরেই টেলিভিশনের পর্দা কালো করে সেই নির্মম দৃশ্য। ভেঙে পড়েছে পোস্তা উড়ালপুলের নির্মীয়মাণ অংশ। প্রায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিলেন সেদিন, নিয়তি প্রাণ করেছিল ২৫ জন নিরীহের। সেদিন অদৃষ্টের কাছে আকুতি ছিল, এমন দৃশ্য যেন আর দেখতে না হয়। বিধাতার কি পরিহাস, দুই বছর কাটতে না কাটতেই আবার ভেঙে পড়ল একটি ব্রীজ। খাস কলকাতায়। এবারে উত্তর নয় – ঘটনাস্থল দক্ষিণে।
মাঝেরহাটকে প্রাণকেন্দ্র বললে কম বলা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাথে কলকাতার সংযোগকারী এই জায়গা। লক্ষ লক্ষ মানুষ রোজ মাঝেরহাট পেরিয়েই কর্মক্ষেত্রে যান। এহেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উড়ালপুল ভেঙে পড়াতা নিতান্তই অনভিপ্রেত। প্রত্যেকটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, প্রাণহানি হয়েছে এক জনের। বলাই বাহুল্য, এই ভাঙা ব্রীজ নিয়ে তোলপাড় রাজ্য – এমনকি জাতীয় – রাজনীতি।
ঘটনার সুত্রপাত ৪ঠা সেপ্টেম্বর, বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে যায় ডায়মন্ড হারবার রোডের মাঝেরহাট ব্রীজের একাংশ ।ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেতুর উপরে থাকা বাইক স্কুটি মিনিবাস সহ কয়েকটি গাড়ি। ঘটনার খবর পাওয়া সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হন রাজ্য দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, কুইক রেসপন্স টিম। প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে উপস্থিত হন পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ও মহানাগরিক। ঘটনাস্থলে আসে একদল ফরেনসিক টিম। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও নগরপাল সহ রাজ্যের কর্তাব্যক্তিরা। প্রশাসনের তৎপরতায় অনেকগুলি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়।
মুখ্যমন্ত্রী দুর্ঘটনার সময় ছিলেন দার্জিলিঙে। জানামাত্রই তিনি কলকাতা ফিরতে চেয়েছিলেন কিন্তু পাহাড় থেকে সমতলে ফেরার যোগাযোগ ব্যবস্থা দিনের আলো কমে গেলে অপ্রতুল হয়ে যায় বলে তিনি দার্জিলিং থেকেই খবর নিতে থাকেন উদ্ধারকাজের। সাংবাদিকরা বারংবার তাকে দুর্ঘটনার দায় নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেও তিনি স্থিরচিত্তে জবাব দিয়ে গেছেন, আগে উদ্ধারকাজ পরে দোষারোপ।
দুর্ঘটনার দায় নিয়ে সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিশাল সংখ্যক মানুষ রাজ্য সরকারকেই দায়ী করে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কুৎসায় লিপ্ত ছিলেন। উল্টোদিকে অনেকে শহরের অন্যান্য সেতুগুলির স্বাথ্য সম্পর্কে উষ্মা প্ৰকাশ করেছেন। কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মী এর সঙ্গে তোষণের রাজনীতি এবং নীল-সাদা রঙ ইত্যাদি প্রসঙ্গও যোগ করে দিয়েছেন।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল এই সেতু বিপর্যয়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশের রাষ্ট্রপ্রতি থেকে শুরু করে বিজেপির তাবড় নেতা টুইট করে শোকপ্রকাশ করেন। বাংলায় দাঁত ফোটাতে মরিয়া বিজেপি যে এই বিপর্যয়কে হাতিয়ার করে রাজনীতি করতে চলেছে তার আভাস মিলেছে। ঘটনার ৫ মিনিটের মধ্যে মিডিয়াকে ডেকে ঘটে করে রাজ্য সরকারকে দুষেছেন সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া একজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এই ঘটনাকে রাজ্যের অপশাসনের নিদর্শনই বলছেন বিরোধীরা। ভাবটা এমন যেন পৃথিবীর কোথাও কোনোদিন ব্রীজ ভেঙে পড়েনি, এই প্রথম এরকম বিপর্যয় ঘটল। মজার ব্যাপার হল, এই বিজেপি নেতারাই কিন্তু জুলাই মাসে বারাণসীতে নির্মীয়মাণ একটি উড়ালপুল ভাঙার পর মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। সে যাত্রায় মারা গেছিলেন ১৯ জন। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দটি করেনি।
মাঝেরহাট উড়ালপুলের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ছিল, দ্বিমত নেই সেই ব্যাপারে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ব্রীজ মেরামতির নির্দেশ দিয়েছিলেন জুলাই মাসে। পূর্ত দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে। অনেক মহলের ধারণা ব্রীজের অনতিদূরে মেট্রোর কাজ চলাকালীন ভাইব্রেটর ব্যবহারের ফলে মাটি নরম হয়ে যায়। বৃষ্টি-আগাছার কারণে আরও দুর্বল হয়ে পরে এই উড়ালপুল, এবং শেষ পর্যন্ত ভার সইতে না পেরে নিচের খালে সলিল সমাধি। যেহেতু রেল লাইনের ওপর দিয়ে গেছে এই ব্রীজটা, দায় কি বর্তায় না রেলের ওপর?
এই সব প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎ দেবে। করণীয় যা, তা হল কলকাতা সহ রাজ্যের প্রত্যেকটি সেতুর স্বাস্থ্যে অডিট হয় দরকার। শুভস্য শীঘ্রম। মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আস্থা আছে, বিহিত একটা তিনি করবেন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )